ঢাকা: ‘একক বুলবুলই এদেশের নৃত্যশিল্পকে বিশ্বের নৃত্যশিল্পের মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছেন, আর নিজেও একক সাধনার দ্বারা পৌঁছে ছিলেন নৃত্যশিল্পের উচ্চতর মানে। ’ নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অন্যতম কথাশিল্পী সাহিত্যিক আবুল ফজল করেছিলেন এমন উক্তিই।
সত্যিই তাই; বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বুলবুল চৌধুরী মনে প্রাণে যেমন একজন সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন, তেমনি নৃত্যে ছিলেন স্বশিক্ষিত। একাধারে ছিলেন চিত্রশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ও নাট্যশিল্পী। বহুমুখী প্রতিভার গুণী এ শিল্পী ও উপমহাদেশের কিংবদন্তি নৃত্যপরিচালকের ১০২তম জন্মবার্ষিকী শুক্রবার (১ জানুয়ারি)।
১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া থানায় জন্মগ্রহণ করা এ শিল্পী পাঁচ বছর বয়সে গৃহশিক্ষকের কাছে আরবি-ফারসি শেখার মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবনের শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। শৈশব থেকেই নাচ, গান, ছবি আঁকা এবং গল্প-কবিতা লেখার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ জাগে। ১৯৩৪ সালে মানিকগঞ্জ হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত এক চিত্র প্রদর্শনীতে তার আঁকা ছবি প্রথম পুরস্কার লাভ করে। তবে নৃত্যশিল্পী হিসেবেই তিনি অধিক খ্যাতি অর্জন করেন।
মানিকগঞ্জ হাইস্কুলের এক বিচিত্রানুষ্ঠানে স্বরচিত ‘চাতক-নৃত্য’ পরিবেশনের মাধ্যমে তার নৃত্যশিল্পী জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ছাত্রাবস্থায় প্রেসিডেন্সি কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি সাধনা বসুর সঙ্গে যৌথভাবে পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নৃত্যনাট্য কচ ও দেবযানী। এটি ছিল তার শিল্পীজীবনের মাইলফলক।
অকুতোভয় বুলবুল দৃঢ় মনোবল নিয়ে জীবনের যেকোনো পর্যায়ে সদর্পে এগিয়ে গেছেন। তিনি জীবন বাজি রেখে শেষদিন পর্যন্ত নৃত্যশিল্পের উন্নয়ন, প্রচার ও প্রসারের জন্য বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল অধিষ্ঠানের জন্য চিন্তা ও চেষ্টা করে গেছেন। আর এ অনন্য বহুমুখী প্রতিভাবান শিল্পী বিশ্বাস করতেন, ‘জ্ঞানের আলো পূর্ণতার পথে এগোতে সাহায্য করে’। তাই তিনি প্রায়ই শিল্প-সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করতেন। ফলে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার হতো, অন্তর হতো আলোকিত।
বুলবুল চৌধুরীর আসল নাম রশীদ আহম্মেদ চৌধুরী, ডাকনাম টুনু। বুলবুল চৌধুরী তার পোশাকি নাম। আর্থিক সচ্ছলতায় বেড়ে ওঠা বুলবুলের নৃত্যের কারণে প্রশংসার ঝুলি ছিল পরিপূর্ণ। সময় গড়াতেই মাথার মুকুটে যোগ হয়েছে একের পর এক বিজয় পালক। দেশে–বিদেশে নৃত্য পরিবেশন করে পেয়েছেন ভূয়সী প্রশংসা। নৃত্যশিল্পকে জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে সে যুগের রক্ষণশীল সমাজে নৃত্যকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে বুলবুল চৌধুরী ছিলেন পথিকৃৎ।
শুধু নৃত্য নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তিনি ‘প্রাচী’ (১৯৪২) শিরোনামে একটি উপন্যাসও রচনা করেন। এছাড়া তার লেখা কয়েকটি ছোটগল্পও রয়েছে। ১৯৫৪ সালের ১৭ মে কলকাতায় মৃত্যু হয় এ গুণী শিল্পীর। জীবনের এই স্বল্পপরিসরে বুলবুল কত কাজ, কত অসাধ্যই না সাধন করেছেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সের ছোট্ট এক জীবনে তিনি নৃত্যকে দিয়েছেন শিল্পের মর্যাদা। নৃত্যশিল্পে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তার নামে ১৯৫৫ সালের ১৭ মে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি।
নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীর শততম জন্মবার্ষিকীতে নৃত্য শিল্পীরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে তাকে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে নৃত্যাচার্য্য বুলবুল চৌধুরীর ১০২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এছাড়া অন্যান্য সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীও এ মহৎ জনকে স্মরণ করবেন নিজ নিজ পরিধিতে।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২১
এইচএমএস/আরআইএস