ঢাকা: প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সবকিছুর মতো স্থবির ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনও। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে প্রায় সাত মাস পাঁচ দিন বন্ধ ছিল সংস্কৃতির সূতিকাগার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
তবে করোনার ধকল কাটিয়ে গত বছরের ২৮ আগস্ট নাটক সরণিখ্যাত বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চায়ন শুরু হয়। শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের প্রযোজনায় মোমেনা চৌধুরী অভিনীত একক নাটক ‘লাল জমিন’ ছিল শারীরিক উপস্থিতির প্রথম মঞ্চ নাটক। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ অক্টোবর থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয় নাটকের মঞ্চায়ন। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে সরব হয়ে উঠেছে নাটকপাড়া।
করোনার পর শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথম ছয় মাস বিনা ভাড়ায় নাটক মঞ্চায়নের সুযোগ পাওয়ায় দেশের বেশ কয়েকটি নাট্যদল নতুন প্রযোজনাও মঞ্চে আনে। প্রতিটি মঞ্চায়নে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নাটক মঞ্চায়ন করছে নাট্যদলগুলো। সেসব নাটকের আলোর ঝলকানি আর সংস্কৃতিকর্মীদের শৈল্পিকতায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে নাটকপাড়া। জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হলসহ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে নাট্যকর্মীদের সংলাপ আর অভিনয়শৈলীতে নান্দনিক আবহ আসে শিল্পানুরাগীদের মধ্যে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী জানিয়েছেন, নাটক তথা সংস্কৃতির চর্চায় ব্যাঘাত ঘটলে সমাজে ক্ষতিকর কাজের সংখ্যা বেড়ে যায়। দেশের সব ক্রান্তিকালে শিল্পীসমাজ সবসময়ই বড় ধরনের ভূমিকা রেখে থাকে। করোনাকালেও জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম সচল ছিল। মিলনায়তন খুলে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সবসময় শিল্পীদের পক্ষে ছিলাম। সংস্কৃতিবান্ধব সরকারের আন্তরিকতার কারণেই বিনা ভাড়ায় হল বরাদ্দের ব্যবস্থা করে নাটক মঞ্চায়নের জন্য আমরা মিলনায়তনগুলো খুলে দিতে সক্ষম হয়েছি। পরিস্থিতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত শুক্র, শনি ও সরকারি ছুটির দিনগুলোতে নাটক মঞ্চায়নের অনুমতি রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে একাডেমির মঞ্চগুলো সপ্তাহের সাতদিনই উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এদিকে মঞ্চে নাটক প্রদর্শনীতে বেশ সাড়া পড়েছে নাটক ভালোবাসা মানুষগুলোর মধ্যে। করোনার মধ্যে যেখানে ঘর থেকে বের হওয়া দায়, সেখানে একটু বিনোদনের ব্যবস্থা অনেকটাই মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে আরিফ আলম নামের একজন দর্শক ও নাট্যকর্মী জানান, লকডাউনের কারণে যে কয়েকদিন ঘরবন্দি ছিলাম, তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। তবে সপ্তাহে দুই-একদিন করে হলেও যে এখন মঞ্চ খোলা, নাটক মঞ্চায়ন হচ্ছে, এটি আনন্দের। অন্তত বিনোদনের জন্য এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে। তাই প্রতি সপ্তাহেই বন্ধুরা মিলে নাটক দেখতে আসি।
এদিকে মঞ্চ নাটকের আবেদন দিন দিন বেড়েই চলেছে। তরুণরা ঝুঁকছে মঞ্চের প্রতি। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নাটককে পড়ালেখার বিষয় করা হয়েছে। সেসব ইতিবাচক দিক সামনে রেখেই করোনার সময়েও মঞ্চে এসেছে একাধিক নতুন নাটক। আর নতুন এই নাটকগুলো চঞ্চলতা ছড়িয়েছে দর্শক হৃদয়ে।
নতুন এই নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শৌখিন থিয়েটারের ‘ধূম্রজ্বালা’, ঢাকা থিয়েটারের ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’, অনুরাগ থিয়েটারের ‘অবজেকশন ওভাররুলড’, নৈবেদ্য থিয়েটারের পঞ্চম প্রযোজনা ‘প্রত্যাবৃতা’, প্রাঙ্গণেমোর এর ‘মেজর’, পদাতিক নাট্য সংসদের ‘পাকে বিপাকে’, স্পর্ধা প্রযোজিত ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’ ইত্যাদি।
এছাড়া করোনা পরবর্তী এই সময়ে মঞ্চায়নে নতুন মাত্রা পেয়েছে নাট্যদল এম্পটি স্পেস’র নাটক ‘এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’।
এছাড়া বছরের শেষ দিকে বিজয় দিবসে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন নাট্যদল ‘থিয়েটারিয়ান’। গত ১২ ডিসেম্বর ২৭ জন সদস্য প্রাঙ্গণেমোর থেকে এই নতুন দলটি গঠন করে। শিগগিরই দলটি নতুন নাটক মঞ্চে আনার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া বছরের শুরুতে গত ৪ জানুয়ারি ‘মানুষ’ নাটকের প্রদর্শনীর মাধ্যমে অভিষেক হয় নতুন নাট্যদল ‘শূন্যেয়া’র। সব মিলিয়ে বলা যায়, করোনাকে পাশ কাটিয়ে মঞ্চ খুলতেই তাতে লেগেছে প্রাণের উচ্ছ্বাস।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ এবং নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার জানান, আমরা যারা মঞ্চে কাজ করি মঞ্চ নাটক তাদের কাছে বড় ক্ষুধা। সেই ক্ষুধা মেটাতে আমরা নতুন নতুন নাটক মঞ্চে আনি। এই রকম সংকটকালেও মঞ্চকর্মীরা যেভাবে মঞ্চের জন্য নতুন নতুন নাটকের মহড়া করছে তা রীতিমত অবাক করার ব্যাপার। কাজেই এগুলো দেখেই বোঝা যায় আমাদের মঞ্চ নাটক অনেক দূর এগিয়েছে এবং আরও এগোবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২১
এইচএমএস/আরএ