ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

২০ বছরের সাধনায় ৩ বই, যার প্রতিটি শব্দই শুরু ‘ক’ বর্ণে

মেহেদী নূর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১
২০ বছরের সাধনায় ৩ বই, যার প্রতিটি শব্দই শুরু ‘ক’ বর্ণে

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: এস এম নাজমুল কবির ইকবাল (ছদ্মনাম ইসমোনাক)। যিনি সাহিত্য সাধনায় জীবনের দুই যুগেরও বেশি সময় পার করেছেন।

সেই সাহিত্য সাধনার বলেই তিনটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার তিনটি গ্রন্থের শব্দ সংখ্যা ২৭ হাজার। আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ তিনটি গল্পের বইয়ের প্রতিটি শব্দই শুরু হয়েছে ‘ক’ বর্ণ দিয়ে।  

কেষ্ট কবি, কেষ্ট কবির কনফারেন্স ও কেষ্ট কবির কষ্টগুলো। এ তিনটি গ্রন্থে জীবনের কঠিন বাস্তবতার নিদারুণ চিত্র ভেসে উঠেছে। যা বহু পাঠককে অশ্রুসিক্ত করেছে।  

একটি মাত্র বর্ণের ওপর ভর করে তিনটি গল্প রচনা, অনবদ্য সৃষ্টি বলে মনে করে পাঠক সমাজ। তার এ গ্রন্থগুলো ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৬ সালের একুশের বই মেলায় স্থান পায়। যা পাঠকদের নজর কাড়ে। কিন্তু দুর্দান্ত এ লেখকের ২৭ বছরের সাহিত্য সাধনায় যতটা পেয়েছেন, তার চেয়ে খুইয়েছেন বেশি। এমনকি সাহিত্য সাধনায় নিমগ্নতার কারণে ছেড়ে গেছেন স্ত্রী-সন্তানও। আর তাইতো এ লেখক ডুঁকরে কেঁদে উঠে বলেন, জীবনের সব কিছুই তো খুইয়েছি। এখন সাহিত্যটাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। নিজের কষ্টের অনুভূতি-উপলদ্ধিগুলো সাদা কাগজেই লিখে যাই।  

সৃজনশীল এ লেখকের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে। ১৯৬৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মেধাবী এ লেখকের জন্ম। গ্রামের মক্তবে শিক্ষাজীবনের শুরু। যা শেষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের মধ্য দিয়ে।  

তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি ঘরে তার ঠাঁই। পরিবার ও চাকরি বাকরি না থাকায় ভাইদের সহযোগিতায় জীবন কাটাচ্ছেন তিনি।

তার অনন্য সৃষ্টি নিয়ে কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে লিখতাম-পড়তাম। বিশেষ করে বিশ্ববরেণ্য লেখকদের লেখা পড়তাম। আমার একটা স্বপ্নও ছিল। একদিন বাবা আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন, বাবা তুমি অনেক বড় হবে। আমি লেখাপড়া শেষ করে বেকার জীবন কাটিয়েছি কিছুদিন। চাকরি খুঁজেছি, চাকরি পেয়েছি, আবার হারিয়েছি। দেখলাম, বড় হওয়ার যে স্বপ্ন, সেটা চাকরি করলে মিথ্যে হয়ে যাবে। বাবার যে  আশীর্বাদ, হয়তো কোনোদিন কাজে লাগবে না। জীবন চলার পথে দেখলাম যে সাহিত্য, শিল্প ও সংঙ্কৃতি এমন এক জিনিস, যার কোনো দেয়াল নেই। তার বিস্তৃতি বিশ্বজুড়ে। এ নিয়ে অনেক কিছু ভাবা যায় বা করা যায়। এটা মানুষের মননে ও হৃদয়ে কাজ করে। সে দিক চিন্তা করে বাংলা সাহিত্যের নতুন উদ্ভাবনের চিন্তা ভাবনা নিয়ে আমার এগিয়ে চলা। একে একে ২০টি বছর পার করে দিয়েছি এ নতুন উদ্ভাবনের জন্য। এমনকি একটি শব্দ খুঁজতে গিয়ে আট মাস ঘুরেছি বিভিন্ন গ্রন্থাগারে।  

‘ক’ বর্ণকে কেন বেছে নেওয়া- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক বর্ণটা বেছে নেওয়ার একটাই কারণ, আমি দীর্ঘ সময় বর্ণ শব্দ খুঁজেছি। এর মধ্যে দেখলাম যে ক বর্ণ দিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক বেশি শব্দ তৈরি করা যায়। অনেক বেশি শব্দ না হলে দেখা যায়, কাব্য বা গল্প লেখা যায় না। ভাব প্রকাশের জন্য অনেক বর্ণ শব্দ লাগে। যেখানে যে শব্দ ব্যবহার করলে কাব্যরস বের হয়, সেভাবেই লিখেছি।

এ শব্দ খোঁজা এবং একে গল্প আকারে রূপ দিতে আমি প্রথমে চার/পাঁচ বছর গবেষণা করেছি। লক্ষ্য ছিল, এমন কিছু সৃষ্টি করা, যা বাংলা সাহিত্য তথা পৃথিবীর সব সাহিত্যের জন্য উদাহরণ। একটা বর্ণকে আদ্যক্ষর রেখে কোনো সাহিত্য রচনা করা যায় কি না। এর জন্য প্রায় এক যুগ ধরে শব্দ সংগ্রহ করেছি। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, জার্নাল, অভিধান থেকে প্রায় আড়াই লাখ শব্দ সংযুক্ত করেছি। যার প্রতিটি শব্দ ক দিয়ে শুরু। এতে করে দেখলাম গল্প বা কিছু লিখতে পারব। তারপর ২৭ হাজার শব্দের তিন পর্বের গল্প লিখতে সক্ষম হয়েছি, যোগ করেন লেখক ইসমোনাক।  

তিনি বলেন, জীবনে একটা মানুষ অনেক কিছুই আশা করে। অনেক কিছু আশা ছিল আমারও। কিন্তু প্রাপ্তিটা অনেক কম। আমি জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমার এ লেখাকে মানুষের হাতে তুলে দিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেক লোক আমাকে তিরষ্কার করেছেন। তবু আমি পিছপা হইনি। আমি আমার সৃষ্টিকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছি। এখন মানুষ বুঝতে পারছে, আমি কিছু একটা করেছি। এটা আমার প্রাপ্তি।

আমি গল্পগুলোতে কেষ্ট কবি নামের চরিত্রটি মূলত নিপীড়িত সাধারণ মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। সেই নিপীড়িত ব্যক্তির সুখ, দুঃখ, হাসি আর কান্না তুলে ধরেছি গল্পে।

এখন আমার একটাই চাওয়া, আমার এ সৃষ্টি যেন বিশ্বে থাকা ৪০ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছায়। আমার সাহিত্যকর্মকে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে স্থান দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে সঠিক কোনো ধারণা না থাকায় তাতে ব্যর্থ হই। এখন আমার চাওয়া, যে সৃষ্টির পেছনে আমার জীবন, যৌবন, চাকরি এমনকি পরিবারও হারিয়েছি, সেই সৃষ্টিকর্ম যেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে স্থান পায়।

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ইসমোনাকের এ সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে তথা বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। আশা করি, গবেষণার মাধ্যমে এ সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বেরিয়ে আসবে।

জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খান বাংলানিউজকে বলেন, ইসমোনাক তার তিনটি গল্পের বইয়ের প্রতিটি শব্দের আদ্যাক্ষর ক বর্ণ দিয়ে শুরু করেছেন। এটি একটি অভিনব সাহিত্যকর্ম। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি বিরল। বাংলা সাহিত্যেও এ রকম নজির আর নেই। এমন একজন লেখকের পাশে দাঁড়াতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা জানানোর পাশাপাশি আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করা হয়েছে। এছাড়া তার বইগুলো নিয়ে প্রচারণার উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১
এসআই


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।