বরিশাল: অদম্য ইচ্ছে শক্তি আর দৃঢ় মনোবল থাকলে যেকোনো মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় বহুদূর। তবে ইচ্ছে থাকলে যে এক চোখ দিয়ে সামাজিক, পারিবারিক বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি টানা ছয় দশক ধরে নিয়মিত বই পড়া এবং লেখার কাজটি নিখুতভাবে করা যায় তার বড় উদাহরণ ৬৫ বছরে পা দেওয়া আনিসুর রহমান স্বপন।
আর স্বপনের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় দেশি-বিদেশি লেখকদের বইয়ের সংখ্যা ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যে বইগুলো স্বপন তার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সন্তানের সহায়তায় নিয়মিত দেখভাল করে গুছিয়েও রেখেছেন। প্রয়োজনে গবেষক, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা এসব বই পড়ার সুযোগও পাচ্ছেন বিনামূল্যে। এ বইয়ের ভাণ্ডার সংরক্ষণ করতে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে বরিশাল নগরের সদররোডস্থ নিজের পৈত্রিক ভিটে এবং কাউনিয়া প্রধান সড়কের শশুরালয়ে আলাদা দুটি সংগ্রহশালাও গড়ে তুলেছেন স্বপন। এ কাজে তার স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত প্রভাষক বেগম ফয়জুন নাহার শেলী সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছেন।
জানা গেছে, ১৯৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় জন্ম নেন লেখক ও সাংবাদিক আনিসুর রহমান স্বপন। জন্ম ঢাকায় হলেও পড়াশোনা করেন বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল ও ব্রজমোহন কলেজে। বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং পরে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কিছুদিন এম ফিল এবং ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করলেও তা অসমাপ্ত রেখে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত থাকেন তেহরানে। সেখানে কাজ করেছেন রেডিও তেহরানের বাংলা অনুষ্ঠানে এবং ডেইলি তেহরান টাইমসে। আর তেহরান থেকে ফেরার সময় পরিবারের জন্য তেমন কিছু না আনলেও পড়ার জন্য ছয়শত কেজি ওজনের বইয়ের ঝুলি এনেছেন আলাদাভাবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, স্বপন মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বরিশাল নগরের বগুড়া রোডের বাড়িতে গোসলখানায় খেলতে গিয়ে ডান চোখে তীব্র আঘাত পান। যে আঘাতে তার চোখটি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে একচোখে দীর্ঘ ছয় দশক ধরে নিজের প্রতিটি কাজ করে চলছেন। বিশেষ করে বইপ্রেমী এ ব্যক্তি প্রতিনিয়িত নতুন নতুন বই পড়া আর নিয়মিত লেখার কাজটি করে যাচ্ছেন।
আনিসুর রহমান স্বপন বাংলানিউজকে বলেন, আমার মনে হয় অন্যান্য যে কোনো নেশার থেকে বই সংগ্রহ করা ও পড়া আর মারাত্মক এবং ব্যয়সংকুল নেশা। আর আমি মনে করি পাঠ অভ্যাস করাটা আমাদের সবার জন্য জরুরি। তবে অনেকেই ইউটিউব বা বিভিন্ন মাধ্যমে পড়ার চেষ্টা করি, তবে প্রিন্ট বই পড়ার মজাটা পাওয়া যাবে না। এখনো মুদ্রিত বইয়ের আকর্ষণ রয়েছে এবং উত্তরাত্তর বাড়ছে এবং বাড়বে।
তিনি বলেন, বাবা প্রয়াত আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইসমাইল খানকে দেখে ছোটবেলা থেকেই বই পড়া তার খুব সখ ছিল। মাত্র চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে ডান চোখে আঘাত পাই। এরপর বিভিন্নভাবে চিকিৎসা করালেও চোখটি ভালো হয়নি, শুরু হয়ে যায় একচোখের জীবন। তবে এমনও দিন গেছে চোখের ডাক্তার দেখানোর টাকা দিয়ে নতুন বই কিনে আনতাম। আবার সদররোডের বাসার নিচতলার দোকানের ভাড়া অনেক মাসেই আব্বা নিতে পারতেন না। কারণ বই কিনে কিনে ভাড়ার টাকা খুইয়ে দিতাম। তারপরও বই পড়া কখনো ছাড়িনি। মাত্র একটি চোখের ওপর চাপ দিয়ে বই পড়া চালিয়ে গেছি। এখনও এমন দিন যায় বই পড়তে পড়তে রাত-ভোর হয়ে যায়। আর বই পড়া থেকেই লেখার প্রতি আগ্রহটা সৃষ্টি হয়। তবে বয়স হওয়ায় মাঝে মধ্যে কিছুটা কষ্টও হয়।
ব্যক্তি জীবনে ষাটোর্ধ আনিসুর রহমান সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেও নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাসের ফলে অর্জিত জ্ঞানকে পুঁজি করে নিজেও লেখালেখির কাজটি করছেন। এরইমধ্যে তার সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, অপেক্ষায় রয়েছে আরও বেশকিছু। ফার্সি ভাষার ব্যাকরণ নামে তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। এরপর ১৯৯৩ সালে পারস্যে রবীন্দ্রচর্চা, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য, ১৯৮৬ সালে অনুবাদ “একটি মোরগের কাহিনী”, ১৯৮৭ সালে পারলৌকিক জীবন এবং ১৯৯১ সালে সফরজাদেহ: স্বনির্বাচিত কবিতা নামে তার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আর প্রকাশিতব্য বইয়ের তালিকায় রয়েছে, মাহদী সহেলির কবিতা, দারাশুকো ‘র অনূদিত উপনিষদ, নাজিম হিকমতের কবিতা, খলিল জীব্রানের সুভাষিত সুবচন, জরথ্রুষ্ট্রের আভেস্তা।
তিনি জানান, সংগ্রহে তার দুর্লভ কিছু বই রয়েছে। আর তার সংগ্রহশালায় বিভিন্ন ধরনের বইয়ের মধ্যে ইতিহাস ও দর্শনের বই বেশি রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
এমএস/আরআইএস