ইতিহাস, অনুভূতি আর কল্পনা যখন এক রেখায় প্রবাহিত হয়ে কারও কবিসত্তাকে নাড়া দিয়ে যায় তখন হয়তো প্রকাশের জন্য সে গদ্যকাহিনিকে বেছে নেয়। মূলত কবি শামীম রেজার ‘জীবনানন্দ ও মায়াকো জোছনা দেখতে চেয়েছিলেন’ উপন্যাসিকায় তেমনটি দেখতে পাওয়া যায়।
সাধারণ শব্দমালা, রাত্রি, নক্ষত্র, সমুদ্র—এসব জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কতই না অসাধারণ হয়ে বাজে! তেমনই বেজেছে এই উপন্যাসিকায়। মায়াকোভস্কির আত্মহত্যাও হয়েছে মহিমান্বিত। আর এ সবকিছু লেখক কিংবা তারই নির্মিত চরিত্র অবলোকন করে। প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী হওয়ার উদ্দেশ্যেই হয়তো লেখক তার উপন্যাসিকার চরিত্র নির্মাণ করেন। মোনোলগ বা স্ট্রিম অব কনশাসনেস ধরনে তাই লেখকের বর্ণনা এগোয়। সেখানে কখনো সরাসরি ইতিহাস এসে পড়ে, যা হয়তো অনেকের জানা। কখনো ইতিহাসের গায়ে লাগে লেখকের কল্পনার তুলির আঁচড়। তখনও আবার তারই মাঝখানে এসে পড়ে একজন গদ্যকারের শব্দমাধুর্যের খেলা। ফাঁকে টুকরো টুকরো লোককাহিনি বা মিথ উপন্যাসিকাটির কাহিনির গতিপথকে মসৃণ করে। সব মিলিয়ে একটি আকর্ষণীয় বুনন যা পাঠককে কেবল সামনের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
লেখক বর্ণনা শুরু করেন বহুবচনে। যেন একদল বন্দুবান্ধব আড্ডাচ্ছলে জীবনানন্দ দাশকে আবিষ্কার করছে। আবিষ্কার করছে তার চাঁদ কিংবা নক্ষত্রকে। অথচ কাহিনির বাঁকে বর্ণনাকারী প্রধান চরিত্র কোথাও বহুবচন, কোথাও একাকী একজন, কোথাও যেন স্বয়ং লেখক। কাহিনির অধ্যায়গুলো ভিন্ন নামে রচিত। একেকটি যেন সম্পূর্ণ একেক কাহিনি। আবার কোনো এক সূত্রে তারা একে অন্যের সঙ্গে গাঁথা। সূত্রটি জীবনানন্দ বা মায়াকোভস্কি কিংবা লেখকের আনকোরা কোনো অনুভূতি। যে অনুভূতি ফুঁড়ে বেরোয় জীবনানন্দের দৈনন্দিন কোনো ঘটনা থেকে, কিংবা মায়াকোভস্কির কবিতার কোনো পঙ্ক্তি থেকে।
প্রথম পর্ব বা অধ্যায় জীবনানন্দের ঘরের একটি খুঁটি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। জীবনানন্দে বাড়ি ছাড়ার বহুবছর পরেও বাসিন্দারা ওই খুঁটিটি সরাতে পারেনি। কখনো সরানোর উপক্রম ঘটালেই বাসিন্দাদের ওপরে নেমে আসত কোনো না কোনো বিপদ। তাই বছরের পর বছর খুঁটিটি স্বস্থানেই থেকে যায়। এমনকি দেশভাগের সময়ে যখন রায়ট বাঁধে, তখনও লুটতরাজের মাঝখানে কী করে যেন খুঁটিটি একাকী দাঁড়িয়ে থাকে। আর সেই দণ্ডায়মান খুঁটিতে লেখকের একদল চরিত্র অভাবনীয় জীবনীশক্তি খুঁজে পায়, তাকে জড়িয়ে ধরেই জীবনানন্দের কবিতা আওড়ায়। বর্ণনার কাল চরিত্রদের কাছে অতীতও বটে। তারা কেউ আজ আর তা স্পষ্ট করে মনে করতে পারে না...
‘আমরা ময়ুখের জন্য বরিশাল এসে জীবনানন্দের ঘরের শুধুমাত্র ব্যবহৃত খুঁটিটির ছবি তুলে নেই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে, মনে মনে জীবনানন্দ সংগ্রহশালা কিংবা জাদুঘর হিসাবে কল্পনা করে এই খুঁটিটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করি, আমাদের এই প্রাথমিক সাফল্যে আমরা একদিন ধানসিড়ি নদী পাড়ে জোছনা দেখতে যাই; জোছনা দেখার ঘটনাটি আমাদের অনেকেই ভুলে গেছে এতদিনে। ’
জোছনায় অবগাহন থেকে কবিতায় নিমজ্জন সবই যেন ঘটে লেখকের নির্মিত চরিত্রদের অবচেতনে কিংবা এত সুদূর অতীতে, যার কোনো সীমা নেই। কিংবা আবহমানকাল ধরে এমনই ঘটতে থাকে, যা চরিত্রের অন্তরে ক্রমাগত অনুরণিত হয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে বরিশালে দলবেঁধে বেড়াতে আসা লেখকের চরিত্রেরা জীবনানন্দের ধানসিড়ি নদীর উৎস আবিষ্কার করে। আবিষ্কার করে প্রচলিত লোককাহিনির মাধ্যমে। তাদের কথোপকথনে লোককাহিনির মধ্যে বর্তমানের বাস্তবতাও জড়িয়ে থাকে। তবে সমস্ত প্রচেষ্টাই ধাবিত হয় ধানসিড়ি বা ধানসেদ্ধ নদীটির দিকে। লেখকের চরিত্রেরা গল্পে-কাহিনিতে ধানসিড়ি নদীর উৎপত্তির অদ্ভুত অতীত নিয়ে উপস্থিত হয়। উপস্থিত হয় তার অবস্থানগত ভূগোল নিয়েও। উপন্যাসিকাটি তখন ইতিহাস আর ভূগোলের মিশেলে চমকপ্রদ হয়ে ওঠে।
সত্যি কথা বলতে কী, বর্তমানের সাহিত্যের ধারা তো তাই; গল্প কেবল কল্পকাহিনিতে, প্রবন্ধ কেবল বাস্তব বর্ণনায়, কবিতা কেবল ছন্দ মেলানোতে ব্যস্ত থাকে না। কোথাও কোনোভাবে তাদের সূক্ষ্ম তথা মোটাদাগের পার্থক্যও যেন ঘুচতে চায়। অন্যদিকে, উপন্যাস বা উপন্যাসিকায় কেবল কাহিনির ধারাবাহিক বর্ণনা পাঠকের মনে একঘেয়েমির উদ্রেক করে যদি চরিত্রের বাস্তব অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে দেয়া না হয়। তাই এই অধ্যায়ে এসে বরিশাল শহরকে, শহরের প্রধান সম্পদ, নদীনালাকে পাঠকের মনে এঁকে দেয়া হয়। পাঠক যেন সেই নদীগুলোর তীর ধরে হাঁটে, কল্পনার তোড়ে অবগাহন করে।
পরের অধ্যায়ে আসে ওই ভূগোলের বাস্তব রূপ। অর্থাৎ, জীবনানন্দের ধানসিড়ি নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনযাপন। তারা ঠকে, তারা আশায় বুক বাঁধে, তাদের জীবনের সঙ্গী হয় অভাব আর দুর্দশা। এরই সঙ্গে যেন জড়িয়ে যায় সমাজের এক আদিম অপরাধের ভয়াবহ ঘটনা, ধর্ষণ। ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীর মৃতদেহ ভেসে থাকার কাহিনির সঙ্গে ধানসিড়ি নদীকে চেনার অভিজ্ঞতা মিশে যেতে থাকে। চরিত্রের কল্পনায় কিশোরীর মৃতদেহ নদীর পানিতে ভাসে। তারপর ক্রমে একক বর্ণনায় কিশোরী কাজলা দিদির ধর্ষণ ও নদীতে মৃতদেহের ভাসতে থাকার কথা আসে। ধর্ষণ যে কোনো জৈবিক বিষয় নয়, বরং অনেক বেশি রাজনৈতিক তা স্পষ্ট হয়। রাজনৈতিক কারণে দেশে অরাজকতা, রায়ট এবং পরবর্তীকালে নানা দাঙ্গা-ফ্যাসাদের পরিণতিতে নারীর দেহ ভোগ অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত হয়। উপন্যাসিকার এই অংশ অতি স্বাভাবিক এই পরিস্থিতি তুলে ধরে।
পাঠকের মন তখন কাজলাদিদির জন্য কাঁদে। জীবনানন্দের ধানসিড়ি আর দুর্ভাগা কিশোরীর মৃতদেহ যেন তখন একনামে উচ্চারিত হয়। ধানসিড়ির ওপরে কালিমা লেপা হয়ে যায়। পাঠকের চোখে তখন যেন তা অভিশপ্ত কোনো জলপ্রবাহ মাত্র। লেখকের সুচারু বর্ণনায় পাঠক অসহায় বোধ করে। অসহায় বোধ করে সবকিছুর জন্য যার ওপরে তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সংখ্যালঘুর ওপরে অত্যাচার, সম্পদ ও রাজনৈতিক ফায়দার প্রত্যাশা, এমনকি ক্ষমাতার কুরসিতে বসার নির্বাচনে অসাধুতা, সবকিছুর শিকার জনগণের ক্ষুদ্রাংশ পাঠক তখন যারপরনাই অসহায় বোধ করে।
এরপর কাহিনিতে এক ওলটপালট বিষয় ঘটে যায়। ঘটনাচ্ছলে জীবনানন্দ আর মায়াকোভস্কি নিজেই চরিত্রের সঙ্গে কাহিনিতে আবির্ভূত হন। জীবনানন্দ নিজেই মায়াকোভস্কির সামনে দাঁড়ান। তার মৃত্যুর ঠিক আগের দিন বা সেই দিনটির হিসাব-নিকাশ করতে থাকেন যেন। মায়াকোভস্কির আত্মহত্যার ঘটনার মাধ্যমে উপন্যাসিকার সমাপ্তি টানা হয়। চরিত্রদের কাঙ্ক্ষিত জোছনায় তখন যেন চরাচর ভরে থাকে।
আলোচ্য উপন্যাসিকায় ইতিহাস আর কল্পনার মিশেলে লেখক দ্রুত এবং সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় অসংখ্য বাস্তব-অবাস্তব দৃশ্যের অবতারণা করেন। বর্ণনা অতি সংক্ষিপ্ত হলেও তা পাঠকের মনে আবেগী ছাপ ফেলে। অনুরাগী পাঠক যেন উপন্যাসিকার মাধ্যমে প্রিয় জীবনানন্দ ও মায়াকোভস্কিকে নতুনভাবে, অন্য রূপে খুঁজে পান। অন্যদিকে এখানে তাদের জীবনের অতীত বাস্তবতাকে বর্তমানে পাঠকের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার নিরিখে বিচার করারও বহু নিদর্শন মেলে। পাঠককে জানার পরিধি ও নিজস্ব চিন্তাভাবনার গণ্ডিতে রেখেই কিংবদন্তি কবিদ্বয়কে নতুন করে চেনানোর সফলতাই উপন্যাসিকাটিতে লেখকের সার্থকতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২১
এমজেএফ