ঢাকা: সব্যসাচী লেখক তিনি, সাহিত্যের সবক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ। তবে গল্পকার হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।
ঝর্না রহমানের লেখা সুপাঠ্য, সাবলীল ও চিন্তাময়। আছে জীবনঘনিষ্ঠতা এবং বাস্তববাদিতা। বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখায় এই লেখক পেলেন ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৭’।
মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঝর্না রহমানের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন লেখক-নির্মাতা ফরিদুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন অনন্যা-সম্পাদক তাসমিমা হোসেন।
আয়োজনের শুরুতেই বাচিকশিল্পী লায়লা আফরোজ আবৃত্তি করেন অপরাহ্ণ সুসমিতোর কবিতা এমিল নেলিগান। আবৃত্তি শেষে প্রদর্শন করা হয় ঝর্না রহমানকে নিয়ে তাপস কুমার দত্ত পরিচালিত তথ্যচিত্র। এতে কথা বলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকসহ আরও অনেকে।
ঝর্না রহমানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে হাসান আজিজুল হক বলেন, ঝর্না রহমানের লেখাই তাকে অন্যদের মধ্য থেকে আলাদাভাবে তুলে ধরে। তিনি নিজেকে কখনোই একজন নারী লেখক হিসেবে দেখেন না, আর এটিই তার সবচেয়ে বড় গুণ।
তথ্যচিত্রের শেষে প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন লেখক-নির্মাতা ফরিদুর রহমান। তিনি বলেন, একটি পুরস্কার অবশ্যই সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায়। আমরা অনেকেই আছি যারা শুধু দেখি, কিন্তু ঝর্না রহমান দেখার পাশাপাশি সেটি পর্যবেক্ষণ করেন। শুধু পর্যবেক্ষণই নয়, বরং সেটিকে তিনি বিশ্লেষণ করে, জারিত করে লেখার মাধ্যমে জীবনদান করেন। তার লেখায় সর্বদা একটা লেখক সত্তা কাজ করে, সেখানে নারী বা পুরুষ সত্তা আলাদা নয়। তার লেখার ভাষাগত দক্ষতাও নির্ভুল। যেখানে যেভাবে মেটাফোর, সিমিলি প্রয়োজন, সেখানে সেটি সেভাবেই ব্যবহার করেছেন। আঞ্চলিক ভাষায়ও তার দক্ষতা ঈর্ষণীয়। চিত্রকল্প এবং ভাষা-সংলাপে তিনি যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছেন এবং একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। এছাড়া তার লেখায় রাজনীতিও খুঁজে পাওয়া যায়। তা সমসাময়িক এবং সেই ’৭১; উভয় জায়গাতেই।
ফরিদুর রহমানের কথা শেষ হলে ঝর্না রহমানকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। একসঙ্গে অতিথিরা তার হাতে তুলে দেন শুভেচ্ছাপত্র, সনদপত্র, ক্রেস্ট এবং অর্থ সম্মানী হিসেবে এক লাখ টাকার চেক।
পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে ঝর্না রহমান বলেন, মার্চ মাস আমাদের ইতিহাসের মাস। এই মার্চ মাসে পুরস্কার প্রাপ্তিতে নিজেকে ধন্য মনে করছি। মুক্তিযুদ্ধে ও তার আগে পরে যারা ভাষা ও স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। অনন্যা এত বছর ধরে দ্বীপান্বিত নারীদের সম্মান দিয়ে আসছে। সে তালিকায় নিজের নাম দেখে সম্মানিত বোধ করছি। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে লিখছি। একজন লেখক পুরস্কারের জন্য লেখেন না; সে তার নিজস্বতা, বোধ ও তাড়না দিয়েই লেখে। যিনি লেখেন তিনি পুরস্কার পেলেও লেখেন না পেলেও লেখেন। আর এভাবে বড় পুরস্কার পেলেও যেমন ভালো লাগে, তেমনি লেখালেখির সূত্র ধরে অনেক গুণীজন ও সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি, সেগুলোও আমার জন্য একেকটি বড় পুরস্কার।
আয়োজনের প্রাধান অতিথি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, অনেক কাগজের মধ্য থেকে একটি কাগজ দাঁড়িয়েছে—অনন্যা। তারা যেভাবে কাজ করছে, তা অনন্য। আশা করি এই ধারা অব্যাহত থাকবে। আর ঝর্না রহমানকে সত্যিকার অর্থে সব্যসাচী লেখক বলা যায়। তার কথাসাহিত্য এবং ভ্রমণ সাহিত্যেও কবিতা আছে। কবিতা ভালোবাসেন বলেই এর স্বাদ পাওয়া যায় তার লেখায়। তিনি ৫৬টি বই লিখেছেন, সেখান থেকে যেগুলো পড়েছি, তা মনে গেঁথে আছে। আমার মনে হয়েছে তিনি সত্যিকার অর্থে একজন মেধাবী লেখক।
সভাপতির বক্তব্যে অনন্যা সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, জীবনটা খুব সুন্দর। ঝর্না রহমানও একজন অসাধারণ সুন্দর মানুষ। তার লেখা এত সুন্দর—সেটা এই করোনাকালীন দুঃসময়ে পড়ে বুঝেছি। তার মতো অসংখ্য গুণী মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। আমি হাল ছাড়িনি। করোনায় আমাদের প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে, গল্প আর চিন্তাতেও পরিবর্তন আসবে। আমাদের আরও নতুন মানুষদের তুলে আনতে হবে।
অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার প্রদান শেষে নারী দিবস উপলক্ষে পাক্ষিক অনন্যার আবৃত্তি ও গল্প প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সবশেষে সঙ্গীত পরিবেশন করেন দেশের প্রথম নারী ও আদিবাসী ব্যান্ড দল এফমাইনর। পুরো আয়োজন সঞ্চালনা করেন মোজাফফর হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২১
এইচএমএস/এমজেএফ