১.
দুপুরে কলেজ মাঠে ফুটবল খেলায় বহুদিন পর একটা গোল পেলো সাকিব। এমনিতেই সে মাঝ মাঠের প্লেয়ার।
বাড়ি ফেরার পালা- বৃষ্টির ঝাপটা আরো বেড়ে গেলো। ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছিলো সাকিব ও অন্যরা। তামাশা- হাসি-ঠাট্টা চলছে; আবার, এক বন্ধু আনমনে গুন গুন গাইছে...
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদলও দিনে...
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার ঐ এক লাইনই গাইছে...আড্ডায় মত্ত সাকিবের মনোযোগ সেদিকে...
সবাই চলে গেলে আনন্দ মনে গানটি গাইতে গাইতে বাড়ির পথ ধরে সে...
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে জানি নে...
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না
ঝড়ো ঝড়ো মুখর বাদর দিনে...
এই চঞ্চলও সজল পবন-বেগে
উদ্ভ্রান্ত মেঘে...
মনও চায়.... মনও চায়....
সাকিবের মন কী চায়? কী চায়? এমন দিনে উদ্ভ্রান্ত মেঘে ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলায় মত্ত হতে চায়। জম্পেশ আড্ডা দিতে চায়। মনে পড়ছে, দ্বিতীয় সেমিস্টারে ক্যাম্পাসের সিনিয়র এক আপুকে শ্রাবণ দিনের প্রথম কদম ফুল তুলে দিয়ে বলেছিলো, আপু এই কদম তোমার জন্যে। আপুর সেই কি হাসি, তুইতো বেশ রোমান্টিক।
এবারো নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসে কদম আছে... কাঠগোলাপ?
২.
আজ মনে পড়ে, করোনাকালে হেসে-খেলে-গেয়ে- মন উদাস করে দিন কাটছিলো বেশ। শহর ছেড়ে অনেকদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলো সে। ওদের বাড়িটা মফস্বলে; ঠিক গ্রামও না আবার শহরও না। ঘন বরষায় গ্রামের প্রকৃতি ঘনসবুজ আর বৃষ্টিস্নাত পরিস্কার গাছের পাতা- বনের পাখি- ভরা নদী বিল ঝিল- শীতল বিশুদ্ধ গ্রামের বায়ু। এ এক চমৎকার পরিবেশ, গ্রামের অনূভুতিগুলো দারুন... জীবন সুন্দর- সুন্দর এই প্রকৃতি।
সেদিন খেলা শেষে, বাড়ি ফিরেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেলো সাকিব। বাড়ি থমথমে। ছোট বোনের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সাধারণ একটা অংক মেলাতে পারেনি; আম্মুর বকুনি খেয়ে মুখ গোমড়া করে আছে। এমনি অসময়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে সাকিব; তাও আবার একেবারে আম্মুর সামনে। 'পড়বিতো পড় মালির ঘাড়ে। ' সে যে সময়টায় মাঠে খেললো- প্রতিদিন এই সময়েই সাকিবের ছোট বোনকে পড়ানোর কথা কিন্তু ভেজা শরীরে বাড়ি ফিরে- সে দ্বিগুণ অপরাধী। আম্মুও দ্বিগুণ বেগে শুরু করলো...
'এই যে আরেকটা আসছে। তোর চেয়ে ভালো বিষয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। নিজে পড়েছি আর তোর দুই খালাকে পড়িয়েছি। তারা ভালোভাবে পাস করেছে। আর তুই তোর ছোট্ট বোনটিকে পড়াতে পারছিস না? বোনের দিকে তোর একেবারেই খেয়াল নেই। নিজের চাকরি-বাকরির কোনো খবর নেই। বাড়িতে থেকে ভবঘুরের মতো... এতো কেয়ারলেস! জীবনে কিচ্ছু করতে পারবি না! অথর্ব কোথাকার!
'শিক্ষিত বেকার' ছেলেকে কোনো মেয়েই বিয়ে করতে চায় না...
মায়ের তীব্র বেগে নিসৃত শব্দ আর কঠিন বাক্যবাণ যখন সাকিব আর নিতে পারছিলো না; ঠিক সে সময় স্বয়ং ঈশ্বর যেনো সদয় হয়ে ছোট মামাকে পাঠালেন- উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা হিসেবে। হামজা জাহাজ প্রবল ঝড় আর স্রোতের তোড়ে কাত হয়ে যাওয়া ভাগনে জাহাজকে উদ্ধারে নেমে গেলেন। বড় আপাকে থামানোর চেষ্টা বৃথা। তাই মামা অনেকটা আড়াল করে ভাগনেকে অন্য ঘরে নিয়ে গেলেন।
সপ্তাহে নিয়ম করে একবার এসব কথা শুনতে হয় কিন্তু কেনো যেনো এবার সাকিবের মনে বেশ ধাক্কা লেগেছে। মন থেকে ব্যাপারটা সরছে না। অপমান, লজ্জা নাকি আত্মভিমান? কিসে পুড়ছে সে?
তার কেবলই মনে হয়েছিলো, লঘু পাপে গুরু দণ্ড পেয়েছে সাকিব। ছোট বোন-মামার সামনে আম্মুর এতগুলো কথা- ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলো সেদিন। তার মনটা বিষাদে হু হু করছিলো। জীবনটাই বৃথা; বৃথা এই বেঁচে থাকা।
৩.
চাকরির খোঁজে হয়রান সাকিব; এমনিতেই সময়ের প্রতি তার বিরাট অভিমান। করোনাকাল। ভাবে, করোনা আসার আর সময় পেলো না; পাশ করলাম তিন মাস না যেতেই করোনা। এটা আবার কি জিনিসরে বাবা? সব চাকুরির পরীক্ষা; সব নিয়োগ বন্ধ। সাকিব মিনিমাম ১০ জায়গায় এপ্লাই করে রেখেছে। দু'টোতে ভাইভা দিয়ে এসেছে। কোন খবর নাই। অন্যগুলোতে ভাইবার জন্য এখনো ডাক পড়েনি। নিয়মিত দেশ-বিদেশের খবর রাখে সাকিব। তথ্য জানার জন্য বিদেশি নিউজ ম্যাগাজিন নিয়মিত পড়ে। কিন্তু কোনো আশার আলো পায় না। লন্ডন স্কুলের এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কি যেনো নামটা সেদিন নেচার পত্রিকায় এক ইন্টারভিউতে সাংবাদিক উনাকে প্রশ্ন করছে করোনা ভাইরাসের ভবিষ্যৎ কি? সেই বেটা উত্তর দিলো- We don’t really yet know what's going to happen! এই লাইনটা পড়ে আরো মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো সেদিন। দুই বছর প্রায় হয়ে গেলো... দুনিয়ার সব মানুষ আটকে আছে, আর এতদিন পরে আইসাও উনি বলতে পারেননা মহামারি কবে শেষ হবে! যদি না বলতে পারেন- তাইলে, আর বিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞ হইছেন কেন? বাংলাদেশে আইসা কামরাঙ্গীর চর থেইকা একটা রিকশা ভাড়া নিয়া ঢাকা শহরে চালাইলেইতো পারেন! আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি জীবনেও আপনার করোনা হইবো না। যত্তসব!
সাকিবের টেনশন আরো বেড়ে গেলো আরেকটি তথ্য জেনে। আমেরিকার এমাইটি ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বিশ্বের প্রায় ৮৪টি দেশে গবেষণা করে জানিয়েছে; আমরা যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য প্রতিদিন ওয়েবসাইটে পাই; এটা সঠিক খবর নয়। কারণ বিশ্বের সব জায়গা থেকে তথ্য পাওয়া যায় না। তারা একটি ধারণা করছেন, বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রাপ্ত তথ্যের ১২ গুণ। আর মৃতের সংখ্যা হতে পারে প্রাপ্ত তথ্যের আরও বেশি। মানে, পরিসংখ্যান বলছে, ইতিমধ্যে করোনায় মারা গেছেন প্রায় ৪২ লাখ মানুষ কিন্তু ঐ গবেষণা বলছে প্রকৃতপক্ষে, এটি হতে পারে আরও বেশি। বিশ্বজুড়ে কি একটা ভয়াবহ অবস্থা!
আম্মু কি সেসব খবর জানে? শুধু আমাকে বকা- অপমান করা ছাড়া কিই বা করতে পারেন উনি?
সেদিন, আম্মুর মুখের ওপর বলে দিতে পারতো; 'চেষ্টা তো করছি। করোনার কারণে সব নিয়োগ বন্ধ। আমি কি করবো? আর, তুমি কি জানো আম্মু? আমার পেছনে কতো মেয়ে লাইন দিয়ে আছে?
এই যে ক্যাম্পাসের নূপুর; সাকিবের পেছনে আঠার মতো লেগে আছে, এ কথা কি মায়ের কাছে বলা যায়?
নূপুরের সাথে ওর সম্পর্কটা বেশ অদ্ভুত। এটাকে ঠিক প্রেম ভালোবাসার মতো বলা যায় কিনা; সে জানে না। নূপুরের উপর সাকিব অত্যাচার করেছে প্রচুর। সবচেয়ে বড়ো অত্যাচার- নূপুরের প্রতিদিনের লাঞ্চের টাকা বিভিন্ন বাহানায় কেড়ে নিয়ে; এক প্যাকেট সিগারেট কিনে খাওয়া। আজ সে কথা মনে হলে ভাবে, শত অত্যাচারেও সাকিবের উপর রাগ করেনি নূপুর। এ এক অদ্ভুত মেয়ে!
এই গানটা নূপুরের কাছেই শুনেছিলো-- তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই... সারা বছর ধরে মেঘ জমাই...
একবার সাকিবের মন খুব খারাপ। তাই দেখে, নূপুর ওর খাতায় লিখেছিলো...
'একবুক ব্যথা নিয়ে বন্ধু তুমি....
কেনো একা বয়ে বেড়াও
আমায় যদি তুমি বন্ধু মানো
কিছু ব্যাথা আমায় দাও...
নূপুর একটু ভুল করেছে। গানটায় 'ব্যথা' হবে না হবে 'জ্বালা'। একবুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি... যেই মেয়ে ব্যথা আর জ্বালার মধ্যে যে বিরাট ফারাক; এটা বোঝে না; সে কিভাবে বাংলায় পাস করলো? বিস্ময়!
একদিন নূপুর খুব সুন্দর একটা গান পাঠিয়েছিলো। হোয়াটসঅ্যাপে না ম্যাসেঞ্জারে মনে পড়ছে না!
‘যে তুমি তারার মতো, যে তুমি মেঘের থেকে উঁচু
যে আমি ধুলোর মতো, যে আমি তোমার থেকে নিচু
তুমিতো পরীর বেশে- তুমিতো মায়ার বসে, নামো...
আমি যে ছুটে চলি তোমার পিছু পিছু, থামো।
দেখোতো বনের কাছে... দেখোতো নদীর কাছে... চলো...
বানাবো কাঠের বাড়ি... আমাকে নেবে কি? তুমি বলো?'
আজ পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়-- সাকিব থামেনি। সাকিব থামতে জানতো না। নদীর কাছে যাওয়ার মতো সময় তার হাতে ছিলো না। কাঠের বাড়ি সাকিবের পছন্দ ঠিকই কিন্তু একজনকে নিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সেই কাঠের বাড়িতে থাকার কোন মানেই হয় না। কিন্তু, নূপুর অপেক্ষা করে- সহ্য করে অবজ্ঞা অবহেলা মেনেই - মনে মনে দুঃখ পেয়ে অবশেষে- আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করে।
৪.
আত্মভিমানে পুড়ছে সাকিব। মায়ের তীব্র কটাক্ষ মাথা থেকে যায়নি এখনো। গতরাত থেকে মন গোমড়া করে আছে। কারো সাথে কোন কথা হয়নি। সাধারণত মন খারাপ হয়ে গেলে পছন্দের বই পড়ে সে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস আছে, 'বুকের মধ্যে আগুন'। ওর পছন্দ। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে তার বয়সী যুবকেরা কি কান্ডটাই না করেছিলো রেল স্টেশনে- স্বদেশী আন্দোলনের সময়। দুনিয়ায় কেউ কখনো আস্ত একটা রেল ছিনতাইয়ের কথা শুনেছে? ১০০ বছর আগে সেই সাহস দেখিয়েছে... আমাদের দেশের যুবকেরা। অথচ, সে বাড়িতে আটকে আছে। নির্ভীক অকুতোভয় যুবকদের মতো হতে পারেনি। দেশপ্রেম! হঠাৎ 'দেশপ্রেম' শব্দটা মাথায় আটকালো।
মনে পড়ে, ক্যাম্পাস জীবনের শুরুতে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়েছিলো সাকিব। স্লোগান ধরতো। কোথায় আজ সেই দিন?
কতো বোকা ছিলো সাকিব, আদর্শ-দেশপ্রেম বুলি আউড়িয়ে সময় নষ্ট করেছে! সুনীলের উপন্যাস হাতে নিয়ে নড়েচড়ে দেখে- কিন্তু, কিছুতেই মনের ছটফটানি দূর হচ্ছে না। দিন যত গড়াতে থাকে মনের মধ্যে জমে থাকা ঘনকালো মেঘমালা, আরো ঘন আরো কালো অন্ধকার হয়ে আসে। আজ সারাদিন বাড়ির বাইরে যায়নি। বন্ধুরা খেলার জন্যে ডেকেছিলো; যায়নি। মাকে না বলে বাড়ির বাইরে থাকেনি কোনদিন। কিন্তু; সে আর এ বাড়িতে থাকবে না; এটাই সিদ্ধান্ত। কোথায় যাবে? কোথায় গিয়ে উঠা যায়? কিছুই মাথায় আসছে না।
৫.
বাইরে প্রচণ্ড বর্ষণ। শ্রাবণের বারিধারার বান যেনো ছুটেছে আজ। অভিমান বুকে নিয়ে আম্মুকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো সাকিব। বাড়ির পেছনের সরু রাস্তা ধরে রফিকদের উঠান পেড়িয়ে গেলেই তার শৈশবের খেলার মাঠ। চিরচেনা মাঠ। মাঠ পেরিয়ে খেলার সাথী সুমন, এখন সৌদি প্রবাসী; ওদের বাড়ি। একটানে পেরিয়ে গেলো সে। ঝুম বৃষ্টিতে একটি প্রাণীও বাইরে নেই; শুধুমাত্র সাকিব। ঘন ঝোপঝাড়ের কারণে ওপাশে কিছুই দেখা যায় না। সাহস করে সেই ঝোপ পেরুলেই বিশাল দীঘি। এই দীঘিতেই সবার সাথে সাতার কেটে দিন পার করেছে সাকিব; কিন্তু কোনদিন একা নামেনি...
সারাবছর ঘাটে বাঁধা থাকে ছোট্ট একটি ডিঙি। বৈঠা হাতে নিয়ে... সজোরে চালালো... একটানে দীঘির মাঝখানে- অনিশ্চিত যাত্রা...
এতো বৃষ্টি, এতো বৃষ্টি- দু'হাত দূরে স্পষ্ট করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। শ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছে না সাকিব- চোখ মুখ চুল সব সব পানিতে ভিজে যাচ্ছে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! পানিতে ভিজে যেনো শরীরে বন্যা বয়ে যাচ্ছে- ঠাণ্ডা হিমশীতল বৃষ্টিজল যেনো টইটম্বুর পুকুর আজ পানিতে উপচে পড়বে। প্রকৃতির সারাবছরের জমানো কান্না একদিনেই ঝরে পড়ছে। কিন্তু তারমধ্যেও তার চোখে দুফোঁটা গরম জল-- ঝুম বৃষ্টিতে এতো কান্না জীবনে কখনো কাদেনি সাকিব; ঐ একদিনই।
বৃষ্টিতে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে দু-হাত ভরে পানি জমা করলো সাকিব। হাতের মধ্যে জমানো পানি ফেলে মুখ উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাতে চেষ্টা করে। বৃষ্টির তোড়ে চোখ মেলতে পারছে না। কেবলই তার মনে হচ্ছে; প্রকৃতি কিভাবে বোঝতে পারলো আজ আমার দুঃখের দিন?
বারিস আরো নামে, দীঘির জলের আনন্দ দেখে অবাক-বিস্মেয়ে তাকিয়ে থাকে সে। শ্রাবণের বারিধারার সাথে দীঘির জলের মিলনের দৃশ্য, সেই মিলনের আনন্দে অপূর্ব ছন্দ, অপূর্ব নৃত্যের কলতান। সারাবছর তাহলে দীঘির জল শ্রাবণের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। দুনিয়ায় এ দৃশ্য- এ আনন্দ হিল্লোল; আগে কখনোই কারো চোখে পড়ে নি। বৃষ্টি যতো বাড়ে- সাকিবের মনের ভার ততো কমে।
প্রকৃতির আনন্দ দেখতে দেখতে একসময় তার মনের দুঃখ মিলিয়ে যেতে থাকে...
তবু্ও, মনের ভিতরের ছোট্ট একটা জায়গায় হালকা স্বরে বাজে, সাকিব; ধীর- স্থির- স্থানু- দীঘির জলের মতো- অথর্ব- শিক্ষিত বেকার।
৬.
করোনা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে অনেকদিন হলো। আজ প্রায় ৬ বছর ধরে নিউইয়র্কে আছে সাকিব। ভালো চাকরি করছে- বাংলাদেশি টাকায় অনেক টাকা বেতন। ফেব্রুয়ারি মাস। এখানে আবহাওয়া বৈরী; টানা এক সপ্তাহের তুষারপাতে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। ইমারজেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে। রাজ্যের বিষণ্নতা চেপে বুকে বাসায় বসে আছে সাকিব। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এতক্ষণ অতীত রোমন্থনে চলে গিয়েছিলো সে। সেই শৈশব- সেই মেঠো পথ- সেই দীঘির জল! কেমন আছে ওরা?
ভাবনায় ডুবে আছে সাকিব; সেদিন মায়ের সাথে অভিমান করা একেবারেই উচিত হয়নি। ভুল করেছে সে। আজ মা কতো দূরে... চাইলেই অভিমান করা যায় না...
'আম্মু, কতো দূরে তুমি। কতোদিন তোমাকে দেখি না। আমাকে মাফ করে দিও মা। '
সাকিব! সাকিব! এই সাকিব! হকচকিয়ে উঠে সাকিব। বাস্তবে ফিরে আসে। পাশের রুম থেকে চেঁচাচ্চে বউ। 'মা ফোন ধরে আছে, তোমার সাথে কথা বলবে, কথা বলো। '
একদৌড়ে গিয়ে ফোনটা তুলে নিলো সাকিব। 'আম্মু আম্মু... ও আম্মু, কেমন আছো তুমি মা...'
'আমি ভালো আছি। শোন তোকে একটা জরুরি কাজে ফোন করেছি। তোরতো আবার দিনদুনিয়ার কোন খেয়াল নাই। তোর শহরে তোর বাসার পাশের স্ট্রিটে বোধহয় হবে, গত সপ্তাহে একটা মার্ডার হয়েছে। নাইজেরিয়ান একটা লোক একজন আমেরিকান নেটিভকে খুন করেছে। টিভিতে দেখলাম। তোকে কিন্তু আমেরিকা যাওয়ার আগেই বারণ করেছি কোন আফ্রিকান ছেলের সাথে মিশবি না। সিগারেট খাবি না, তোর অফিসে কোন আফ্রিকান কাজ করে?'
মা কি বলছে সাকিব কিছুই শুনছে না। শুধু একটা কথাই বললো, আরেক দেশে থেকে তুমি এই দেশ নিয়ে কতো চিন্তা করো, আম্মু...
মা কথা বলেই যাচ্ছে... ছেলের জন্যে তার কতো চিন্তা...
সাকিব কানের কাছে ফোনটা পরম যত্নে ধরে রেখেছে, মমতায় ভরা কণ্ঠ শুনছে... আদর করছে... একটু পর পর চুমু খাচ্ছে...
আর ওর চোখ বেয়ে ফোটায় ফোটায় জল পড়ছে...