ঢাকা: দেশের বৃহত্তর বই বিপণন ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাতিঘর পা রেখেছে ১৮ বছরে। সকলের কাছে বই পৌঁছানোর পাশাপাশি অষ্টাদশী এই প্রতিষ্ঠানটি সাংস্কৃতিক চেতনাসমৃদ্ধ জ্ঞানের যোগান দেওয়ার জন্যও কাজ করছে বলে মন্তব্য বিশিষ্টজনদের।
শনিবার (১৮ জুন) প্রতিষ্ঠাবির্ষিকী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানমালার দ্বিতীয় দিন ঢাকায় বাতিঘর পাঠক, লেখক ও শুভানুধ্যায়ীদের স্বাগত জানায়। সারাদিন অসংখ্য শিশু কিশোর যুবক পৌঢ়ের পদচারণায় মুখর ছিল বাতিঘর। বিকেলে চলে মুক্ত আলাপ ও গান। সে আলাপেই উঠে আসে এমন অসংখ্য মন্তব্য।
বিকেলে মুক্ত আলাপে অংশ নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, বই যেদিন থাকবে না, মানব সভ্যতা সেদিন একেবারে ধ্বসে পড়বে। বাংলাদেশের বইয়ের জগতটা ঢাকার অমর একুশে বইমেলা কেন্দ্রিক। মানুষের কাছে বই পৌঁছানোর এটাই যেন একমাত্র মাধ্যম। এর চাইতে দুঃখজনক আর কিছু নেই। বই থাকতে হবে প্রত্যেকটা জেলা শহরে, উপজেলায়, গ্রামে। সেটা কীভাবে করা যায় সে উপায় আমাদের বের করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশে এখন বইয়ের ক্রেতা আছে হয়তো, তবে পাঠক খুব কম। পাবলিক লাইব্রেরীগুলোতে এখন সবাই এসে চাকরির পড়া পড়ে। আর ঠিক তার উল্টোটি, অর্থাৎ প্রকৃত পাঠকরা আসে বাতিঘরে। ভালোবাসা থেকে এ দেশের প্রত্যেকটি বাড়িতে যেদিন লাইব্রেরী গড়ে উঠবে, সেদিনই আমাদের প্রকৃত সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।
তিনি আরো বলেন, বাতিঘর সারাদেশের পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে ভূমিকা রাখছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বড় শহরগুলোয় বাতিঘর বিক্রয়কেন্দ্র খুলছে। আলাদা প্রকাশনা করে মানুষকে ভালো ভালো বই পৌঁছে দিচ্ছে। আমি চাই এটা সব শহরে, সব উপজেলায়, সব গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ুক। বাতিঘর শুধুই একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। একটা মহৎ লক্ষ্যও বাতিঘরের আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। শুধু বৈষয়িক চাহিদা নির্ভর যে শিক্ষাব্যবস্থা এখন বিরাজ করছে, তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক চেতনাসমৃদ্ধ জ্ঞানের যোগান দেওয়ার জন্যও কাজ করছে বাতিঘর। আমি চাই বাতিঘর সফল হোক।
বাংলাদেশে বইয়ের যে একটা বিশাল সম্রাজ্য গড়ে উঠছে, মানসম্পন্ন বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে কাজগুলো করছে বাতিঘর, এই কাজগুলো খুব দরকারী বলে মুক্ত আলাপে মন্তব্য করেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক ও কবি জুয়েল মাজহার।
এ সময় তিনি কলকাতা বইমেলা ভ্রমনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, আমি কলকাতা গিয়েছিলাম বইমেলায়। সেখানে দেখলাম বাতিঘর সম্পর্কে প্রায় সবাই জানে। বাংলাদেশি হিসেবে যখন দেখি কলকাতার বিভিন্ন আড্ডাতে বাতিঘরের কথা উঠে আসছে, তখন খুব ভালো লাগলো। বাতিঘরের মাধ্যমে কলকাতার কলেজস্ট্রীটসহ সেখানকার ভালো ভালো বইয়ের দোকানগুলোতে বাংলাদেশের বইগুলো পৌঁছে যাচ্ছে। বই আদান প্রদানের এই কাজগুলো যদি আরো জোরালোভাবে করা হয়, তবে আমার মনে হয় আগামী পাঁচ বছরে দুই বাংলার মধ্যে বইয়ের যে যোগাযোগ, তা আরো সমৃদ্ধ হবে। আর বাতিঘরের মতো এই কাজটি যারা করছেন, আমি তাদের অভিনন্দন জানাই।
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল বলেন, আমরা যারা শিল্প-সাহিত্য ও প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত আছি, তাদের কাছে এটা অনেক আনন্দের বিষয়। কর্পোরেট লেবেলে বাংলাদেশে এতো ভালো ভালো বই হচ্ছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, ঢাকা; সব জায়গায় যে বিপ্লব সাধন করেছে বাতিঘর, এটা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য বিশাল কাজ। এটার ফল আমরা আর কিছুদিন পর থেকেই পাব। আমরা যখন অনলাইনে হারিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন এমনভাবে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র গড়ে তোলা, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মনোজগতকে আলোকিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, বাতিঘরের এই ১৮ বছরটা খুব অবাক লাগে, মনে হলো সেদিন শুরু হয়েছে। বাতিঘর একটি জিনিস দেখিয়েছে যে, খুব ছোট আকারে শুরু করলেও যদি আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টা থাকে, যদি লেগে থাকা যায়, তাহলে তা একটি বৃহৎ আকার ধারণ করতে পারে। দেশীয় সৃজনশীল বইয়ের যে সহজপ্রাপ্যতার একটা সংকট চলছিল দীর্ঘদিন, সেই সংকট থেকে বাতিঘরের মতো বুকশপগুলো উত্তরণ ঘটিয়েছে। আমি তো বলবো- বাতিঘর আমাদের বাতির সন্ধান দিয়েছে।
এদিন সকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে এসে বাতিঘরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সাবেক সংস্কৃতি সচিব আকতারী মমতাজ, কবি ফরহাদ মজহার, নারীনেত্রী ফরিদা আখতার, অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন, গবেষক আলতাফ পারভেজ, তানজিনা হোসেন, আবদুল্লাহ আল ইমরান, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, কথাশিল্পী ফারুক মঈনউদ্দীন, পারভেজ হোসেন, কবি তুষার দাশ, আফতাব আহমদ, সাজ্জাদ শরিফ, শোয়াইব জিবরান, চঞ্চল আশরাফ, আলফ্রেড খোকন, জুয়েল মোস্তাফিজ, শিল্পী সব্যসাচী মিস্ত্রী, সানজিদা পারভীন তিন্নি প্রমুখ। প্রকাশকদের মধ্যে আগামী প্রকশানীর প্রকাশক ওসমান গণি, কাকলী প্রকাশনীরর এ কে নাসির আহমেদ, অনুপম প্রকাশনীর মিলন নাথ, প্যাপিরাসের মোতাহার হোসেন, সুবর্ণ প্রকাশিনীর শাহরিন হক, পলল প্রকাশনীর খান মাহবুব বাতিঘরকে শুভেচ্ছা জানান।
এ সময় শুভেচ্ছা বক্তব্যে তারা বলেন, গ্রন্থ বিপ্লব ও লেখক বিপ্লব হচ্ছে বাতিঘরের নেতৃত্বে। বাতিঘরের মাধ্যমে মানুষ আবার বইমুখী হয়েছে এবং হচ্ছে। শুধু বই নয়, বইয়ের সঙ্গে নান্দনিক আবহ রয়েছে বাতিঘরে। এখানে বসে অনেকক্ষণ বই পড়া যায়, আড্ডা দেওয়া যায়।
মুক্ত আলাপের মাঝে আয়োজনে গান গেয়ে শোনান মাসফিদা আখতার মালা, মাহবুবা সুলতানা, রীপা রায়, নাদিয়া জান্নাত, তাহমিনা শাম্মী, রবিউল ইসলাম।
উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ১৭ জুন চট্টগ্রাম শহরের চেরাগি পাহাড় মোড়ে ছোট্ট একটা ঘরে বাতিঘর যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটে বড় পরিসরে এবং ঢাকার শাহবাগ ও বাংলাবাজারে ছোট পরিসরে বাতিঘরের শাখা আছে। রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র ঘোড়ামারায় বড় পরিসরে বাতিঘর প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। দেশে বিদেশে যেকোনো জায়গায় বই পাঠানোর জন্য baatighar.com এর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছে অনলাইন বাতিঘর। এছাড়া ২০০৯ সালে প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাতিঘর। ইতোমধ্যে বাতিঘর প্রকাশ করেছে প্রায় ৩০০ বই।
বাংলাদেশ সময়: ২৩১০ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০২২
এমআইএইচ/এনএটি