ঢাকা: সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর নানা স্তরে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে; মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি যখন ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।
প্রশাসনিক ও সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসররা যেকোনো সময় ছোবল মারতে পারে বলে সরকারকে সতর্কও করেছেন তারা।
সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, রাজনৈতিক সংশ্লেষ ছেড়ে তারা সমাজে ঘটে যাওয়া যেকোনো অন্যায়-অবিচার ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রাখবেন কথা, কবিতা, গানে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন মাধ্যমের সংস্কৃতিকর্মীরা ঢাকায় এক সাংস্কৃতিক মহাসমাবেশ করে জানান দেবে, আগামীতে কেমন মানবিক সমাজ দেখতে চান তারা।
শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে তারা এসব কথা বলেন।
‘সংস্কৃতির শক্তিতে জেগে উঠো বাংলাদেশ’ শিরোনামে এবার অষ্টম জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এবার সম্মেলন উদ্বোধন করেন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন।
উদ্বোধনী পর্বে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নাট্যজন সারা যাকের, প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তিশিল্পী আহকাম উল্লাহ।
অধ্যাপক অনুপম সেন বলেন, সাধারণ মানুষ যখন ঠুলি পড়ে থাকে ধর্মান্ধতার, তখন সেই ঠুলি সরানোর দায়িত্ব সংস্কৃতিকর্মীদের। আমি বিশ্বাস করি, এ দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা সবচেয়ে তেজোদ্দীপ্ত, প্রাণবন্ত ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ। কথা-কবিতা, গান, আবৃত্তি ও নাটকে তাদের যে প্রতিবাদ তা কখনো বৃথা যেতে পারে না। তাদের কণ্ঠে যে বিদ্রোহের গান, তা কোনোদিন ব্যর্থ হবে না।
অগ্রজ সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক জোট প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক অনুপম সেন বলেন, আজকে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন, সংগ্রাম তাতে সংস্কৃতিকর্মীরা কখনো স্তব্ধ হয় না। সমাজে যত গ্লানি, অন্যায়, আমলাতন্ত্র সমাজের ঘাড়ে বসে আছে, তার প্রতিবাদে সংস্কৃতিকর্মীদের কণ্ঠ যেন সারা বাংলাদেশ যেন শুনতে পায়।
মামুনুর রশীদ বলেন, সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা আজ আমাকে ব্যথিত করে। সংস্কৃতির যে মর্মকথা তা আমাদের নীতিনির্ধারকরা ঠিক বুঝতে পারেন না বলে আমার মনে হয়। তারা মনে করেন, সংস্কৃতি মানে হল নাটক, গান। কিন্তু সংস্কৃতির মানে হলো মানুষের প্রতিদিনের জীবন। শত শত বছর ধরে এ বাংলা সংস্কৃতিতে নানা উপাদান এসে যুক্ত হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা আলোচনা করুক। পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের পরামর্শে পাঠ্যক্রমে যে পরিবর্তন এসেছে, তার বিরুদ্ধেও সংস্কৃতিকর্মীরা সোচ্চার হোক।
নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তাতে আমাদের ক্লান্তি ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বাংলাদেশ সেদিকে কতটা এগোতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি সংবিধান থেকে সাম্প্রদায়িক উক্তিগুলো মুছে ফেলতে? আজকে যে অর্থনৈতিক বিভেদ বা সামাজিক সমতার কথা বলছি, সেখানে সংস্কৃতিকর্মীদের একটি অভিযাত্রা শুরু করতে হবে। যদি বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই বা ২০১৩ সালের গণজাগরণ করতে পারি, তবে এখনও সৃষ্টিশীলতার মধ্যে দিয়ে আমরা আবারো মানুষের মুক্তির কথা বলতে পারি।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আজ সারা দেশে যে সংস্কৃতিবিমুখতা তা কীভাবে দূর করব? আজ সারা দেশে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, তাতে শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটাতে হবে। গত একুশ বছর ধরে বাংলাদেশ যে উল্টো পথে হাঁটছে, তার বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা কি আমাদের মত করে বাংলাদেশকে পুরোপুরি সাজিয়ে ফেলতে পেরেছি? এটা এক ধরণের ব্যর্থতা। আমাদের সেই দুর্বলতা ও ভুলত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ করতে হবে, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সমন্বয় করে আশু করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ সে তার প্রতিবাদী চরিত্র হারিয়েছে। আমরা সরকারের সুকৃতির গুণগান যেমন গাইবো, তেমনিভাবে যেকোনো অন্যায়ের জোর প্রতিবাদও জানাতে হবে, সমালোচনা করতে হবে। সারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে একটি সপ্তাহব্যাপী সম্মেলন করতে হবে, যেখানে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
সভায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি সারা যাকের জোটের কর্মকাণ্ডকে সরকারের প্রভাবমুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান কোনোভাবে যেন একপেশে না হয়ে যায়। আমরা নিজেদের আরো বিযুক্ত করে শিল্পের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেন বিরত না থাকি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যে বড় ভূমিকা সে কথা তো আমরা ভুলে যাইনি। সেই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
পরে তিনি জোটের কর্মকাণ্ডে নারী শিল্পীদের সামনের সারিতে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান।
মফিদুল হক বলেন, আজ আত্মসমালোচনার জায়গা থেকে আত্মোপলব্ধি ও আত্মজাগরণের সময় এসেছে আমাদের। আমরা প্রতিকূল পরিবেশে যে বড় ভূমিকা পালন করেছি, অনুকূল পরিবেশে তা পালনে ব্যর্থ হয়েছি। আজ যখন সমাজ সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা আচ্ছাদিত তখন আমাদের শক্তি কী হবে, কার্যকরী ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। আজ সরকারের সামগ্রিক অবস্থান কী তা নিয়েও ভাবতে হবে। জোটকে কী করে আরো প্রভাবসম্পন্ন করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আজকে আমাদের জোটের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ আমরা নাকি সরকারের দালাল। আজকে কোনো কর্মসূচি দিলে আওয়ামী লীগ বলে আমরা বামের দালাল, বামেরা বলে আওয়ামী লীগের। কিন্তু আমরা বলতে চাই, আমরা কারো দালাল নই; আমরা মুক্তিযুদ্ধের দালাল। আজকে রাষ্ট্র কাঠামোর সব স্তরে যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি ও গণতন্ত্র বিরোধী শক্তি যখন ঘাপটি মেরে আছে, তার প্রতিবাদে সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক মহাজাগরণের মহা প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২২
এইচএমএস/কেএআর