ঢাকা: বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের উত্থানে লোকসংগীত সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলে মন্তব্য এসেছে তার স্মরণসভা থেকে।
দেশের গুণী সংগীতশিল্পীরা এ সভায় বলেন, আব্বাসউদ্দীন আহমদ বাঙালি মুসলিম রেঁনেসায় অগ্রণী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি রাঢ় বঙ্গের লোকগীতি ভাওয়াইয়া-পল্লীগীতিকে বাঙালির অন্তরে গ্রোথিত করে গেছেন৷
লোকসংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের ১২১তম জন্মবার্ষিকীতে কথা, গানে তাকে স্মরণ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর৷ বুধবার (২৬ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘আব্বাসউদ্দীন আহমদ: জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ৷
আয়োজনে জাতীয় জাদুঘর পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
অধ্যাপক নাশিদ কামাল বলেন, ‘দাদু ত্রিশ, চল্লিশের দশকে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মজাগরণে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তখন কলকাতার এইচএমভি রেকর্ডসে একজন মুসলমান শিল্পী গাইবেন, এ ছিলো অভাবনীয়। এইচএমভি রেকর্ডসের গ্রাহক হতে গেলে গুণতে হতো চার আনা। দাদু ওখানে ‘হিজ মাস্টার ভয়েজ’ থেকে বেশ ভালো রয়্যালিটিও পেতেন। কিন্তু দরিদ্র মুসলমানদের অনুরোধে টুইন রেকর্ডসে দাদু গান রেকর্ড করতে শুরু করলেন। ওই রেকর্ডসের গান নিতে গ্রাহককে গুণতে হত দু আনা। দাদু শুধু শিল্পের বিকাশই ঘটাননি, গানের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন মুসলমান সম্প্রদায়কে রাজনৈতিকভাবেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন৷ ওই সময় তার গানগুলো লেখা ও সুর করতেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নাশিদ কামাল বলেন, ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাঁধলে তা আব্বাসউদ্দীনের মনে গভীর রেখাপাত করে৷ তিনি তখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছেন বাংলার পথে-প্রান্তরে। খোলা ট্রাকে চড়ে তিনি মানুষকে শুনিয়েছেন সম্প্রীতির গান ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের নিবিড় যোগাযোগের কথাও বলেন অধ্যাপক নাশিদ কামাল।
মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে আব্বাসউদ্দীন আহমদ এক যুদ্ধ করেছিলেন। ভারতবর্ষ যখন বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানে বিভক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন চলছে, তখন আব্বাসউদ্দীন আহমদ কেবল গান গেয়েই এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি এইচএমভি রেকর্ডসে কে মল্লিক বা কিরণ কুমারের মতো নিজের নাম না বদলে আব্বাসউদ্দীন আহমদ নামেই গান করেছিলেন। এইচএমভি রেকর্ডস পল্লীগীতি রেকর্ড করতে চাইত না। কিন্তু তার গান তুমুল জনপ্রিয় হওয়ায় তারা পরে আব্বাসউদ্দীনকে দিয়ে অসংখ্য ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গান রেকর্ড করে নেয়।
মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, শিল্পীরা দেশ-কাল-পাত্র ভেদ করে কালে কালে সময়োপযোগী হয়ে উঠেন, তা আব্বাসউদ্দীন আহমদ জীবনের পরতে পরতে প্রমাণ করে গেছেন। বাঙালি সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তাতে তাকে মহীরুহ বললে খুব বেশি ভুল বলা হবে না।
স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিক বলেন, আব্বাসউদ্দীন আহমদ জানতেন, আমাদের সমস্ত গানের মূলে সেই পল্লীগীতি৷ কবি কাজী নজরুলের সংস্পর্শে এসে আব্বাসউদ্দীনের মধ্যে যে দেশাত্মবোধ বা স্বদেশপ্রেমের জাগরণ হয়েছিলো, পরবর্তী সময়ে তিনি বাঙালির অন্তরে সেই পল্লীগীতি-ভাটিয়ালিকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, লোকসংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের গানও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করেছে, ত্বরান্বিত করেছে।
অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, শিল্পী আব্বাসউদ্দীন ছিলেন একজন কীর্তিমান ও অসাধারণ মানুষ। কীর্তিমান সে মানুষ কখনও সত্যের সঙ্গে আপোষ করেননি।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২২
এইচএমএস/এসএ