ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

অপার সৌন্দর্যের সাজেক ভ্যালি

আবদুল হাই ফারুকী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৪
অপার সৌন্দর্যের সাজেক ভ্যালি

বছর দুই আগে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থেকে খাগড়াছড়ি ফেরার পথে ১০ নং পুলিশ ফাঁড়ির পাশে সাজেকের নবনির্মিত রাস্তা চোখে পড়ে। পরবর্তীতে রাঙ্গামাটি জেলার সর্বউত্তরের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত সাজেক ভ্যালির অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা নানা জায়গায় শুনেছি।

পত্র-পত্রিকায়ও এ সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে পারি। জানতে পারি ‌এখানে যাওয়ার দুর্গম পথ সম্পর্কেও। সেই থেকে সাজেক ভ্যালিতে যাবার জন্য মনে মনে ইচ্ছে দানা বাধলেও দুর্গম পথ এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।



কিছুদিন আগে বাঘাইছড়ি প্রেসক্লাবের সভাপতি বন্ধুবর গিয়াস সাহেবের কাছে প্রসঙ্গক্রমে সাজেকের কথা বলতেই তাঁর আগ্রহ এবং অভয় পেয়ে মনে মনে সাজেক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। অবশেষে দেশের রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেই গত ১৪ নভেম্বর আমরা দু’জন (আমি এবং আমার শ্যালক শিহাব) বিআরটিসি বাসে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই।
       
রাতে খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছে হোটেলে অবস্থান করি। এর মধ্যেই গিয়াস ভাই’র সাথে যোগাযোগ হলে উনি পরদিন সকাল সাড়ে ৮টায় দিঘীনালায় আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

পরদিন সকালে খাগড়াছড়ি শাপলা চত্বর থেকে অটোরিকশায় করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই দিঘীনালা পৌঁছাই। সেখানে আগে থেকেই দু’টি মোটর সাইকেল নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন গিয়াস ভাই। মোটরসাইকেলে রওনা হওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছলাম বাঘাইহাট বাজারে।



এবার চা বিরতি। এরই ফাঁকে একটু ঘুরে-ফিরে দেখলাম বাজারটা। অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ। জানতে পারলাম পাহাড়ি-বাঙালির কি এক দ্বন্দ্বের কারণে পাহাড়িরা বাজারে আসা বন্ধ করে দেয়। ফলে এত বড় বাজারের এই জীর্ণ দশা।

মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেল বাজারের এরকম অবস্থা দেখে। চা বিরতির পর রওনা দিয়ে প্রায় ১১টার দিকে  কাসালং নদীর তীরে মাচালং বাজারে পৌঁছলাম।



শুক্রবার হওয়ায় সাপ্তাহিক হাট বসেছে। দূরদূরান্ত থেকে পাহাড়ি নারী-পুরুষ অনেকেই তাদের উৎপাদিত পণ্য যেমন-আখ, বিভিন্ন তরকারি,কমলা, পেঁপে ইত্যাদি বিক্রি করতে আনেন,আবার তাদের সাপ্তাহিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যও কিনে নিয়ে যান।

আমরা যখন পৌঁছলাম তখন বাজার জমজমাট। তবে এই বাজারের বিশেষত্য হলো এখানকার অস্থায়ী দু-একজন বাঙালি ব্যবসায়ী ছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই পাহাড়ি। বাজারটা ঘুরে দেখলাম। আরও লক্ষ্য করলাম সাধারণত হাট-বাজারের মতো হৈ হুল্লোড় এখানে নেই। নেই কোনো হট্টগোলও। বেশ কিছু ছবি তুলে আবারও সাজেক’র দিকে রওনা।



যেতে যেতে দেখি কিছুদূর পর পর পাহাড়িদের ঘরবাড়ি, তাদের প্রাত্যহিক সহজ-সরল জীবনযাত্রা। সুন্দর মসৃণ আঁকা বাঁকা রাস্তা, গগনস্পর্শী পাহাড়, মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে গভীর খাদ, বহু নীচ দিয়ে চলা সরু নদী। সে এক ভয় ধরানো রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগায়, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

অবশেষে ১২টার দিকে আমার বহুদিনের প্রতীক্ষিত সাজেক’র রুইলুই ভ্যালির লুসাই পাড়ায় পৌঁছলাম। নেমেই চারপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্বল হয়ে যাই।



লুসাই পাড়াটি ছবির মতো সুন্দর। অধিবাসীরা সবাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। সবগুলো বাড়িই অনেকটা একই রকম, কাঠের তৈরি,সাজানো-গোছানো। তাদের জীবনযাত্রার মানও অন্য পাহাড়িদের তুলনায় বেশ উন্নত বলে মনে হলো। আবার প্রত্যেক বাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সুন্দর ব্যবস্থা।

দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়শ্রেণি,পরিষ্কার নীলাকাশ, সবুজ বনানীর এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য শুধু চোখে দেখার নয়, অনুভব করার,স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার। যা কোনো ভাবেই ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

এর কিছুক্ষণ পর গিয়াস ভাইয়ের পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের আমন্ত্রণে তাঁর ঘরে গিয়ে বসলাম। যিনি `বুড়া মাস্টার` নামে পরিচিত। তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় জানা গেল,স্বাধীনতার পরেও এই এলাকায় একশ’রও বেশি লুসাই পরিবার ছিলো। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বেশির ভাগ পরিবারই ভারতের মিজোরাম রাজ্যে চলে গেছে। বর্তমানে ১৫-১৬টি পরিবার এই রুইলুই পাড়া এবং কনলাক পাড়ায় বসবাস করে। এছাড়াও আশপাশে কিছু সংখ্যক পাংখো এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসতি রয়েছে।

কিছুক্ষণ পর আমরা আরও প্রায় ১/২ কি.মি. উত্তরে সাজেক ভ্যালির উচ্চতম পাহাড় ‘কনলাক পাড়া’য় গেলাম। সেখানেও গুটিকয়েক লুসাই পরিবারের বসবাস। এই পাড়াটিই এই এলাকার উচ্চতম বসতি। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসার সময় কমলা বাগান দেখলাম। এখানে এখন কফির চাষও হচ্ছে। এরপর বর্ডার গার্ডের BOP তে কয়েকজন জওয়ানের সঙ্গে সামান্য আলাপচারিতা শেষে আবার রুইলুই পাড়ায় এসে ফিরতি পথচলা শুরু।

এই ঢেউ খেলানো বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণির মধ্য দিয়ে আবার মোটর সাইকেলে করে পৌঁছলাম বাঘাইহাট বাজারে। এখানে এক হোটেলে লাঞ্চ সেরে আবার ফিরে চললাম বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে। বাঘাইছড়ি আসার পথে মারিশ্যাভ্যালির দুই পাশের উপত্যকার দৃশ্যও অসাধারণ।

অবশেষে মোটরসাইকেলে প্রায় ১০৮ কিলোমিটারের এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ শেষে বিকেলে বাঘাইছড়ি সদরে পৌঁছে রাতে জেলা পরিষদের বাংলোয় অবস্থান।

পরদিন সকাল ৭টার লঞ্চ ধরে মাইনি নদী এবং কাপ্তাই লেকের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করে সাজেক ভ্যালির মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পাহাড়ি রাস্তায় মোটর সাইকেলের রোমাঞ্চকর ভ্রমণের সুখস্মৃতিসহ একরাশ ভালোলাগাকে আজীবনের সঙ্গী করে রাঙ্গামাটি হয়ে  চট্টগ্রাম ফিরে এলাম।

পাহাড় আর বনানীর এই অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে শেষ করার নয়। যারা পাহাড় ভালোবাসেন তারা এখানে এসে নিরাশ হবেন না।

কিভাবে যাবেন:
দেশের যেকোনো স্থান থেকে চট্টগ্রাম যেতে হবে। সেখান থেকে BRTC আথবা প্রাইভেট গাড়িতে খাগড়াছড়ি গিয়ে রাতে অবস্থান করতে হবে। সেখান থেকে খুব ভোরে অটোরিকশায় আধ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় দীঘিনালা। সেখান থেকে মোটর সাইকেল ভাড়া করতে হবে। সারাদিনের জন্য ভাড়া পড়বে ১৪০০-১৫০০ টাকা।

সন্ধ্যার আগে আবার খাগড়াছড়ি পৌঁছে সেখানে রাতে অবস্থান করে চট্টগ্রাম ফেরা যায়। অথবা সাজেক থেকে দিঘীনালা না এসে বাঘাইছড়ি সদরে চলে যাওয়া, সেখানে রাতে থেকে পরদিন লঞ্চে রাঙ্গামাটি হয়েও চট্টগ্রাম ফেরা যায়। তাতে একের ভিতর দুই পাওয়া হয়ে যাবে।

ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র সেরা লেখকের জন্য তো থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ...। আর ছবি পাঠাতে একদম ভুলবেন না।  

আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন-
bntravellers.notebook@gmail.com
এই ঠিকানায়

আবদুল হাই ফারুকী
চট্টগ্রাম

বাংলাদেশ সময়: ০৬২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।