ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

বিলুপ্তির গ্রাস থেকে ফিরে আসা কিউবান কুমির

তারেক অণু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৪
বিলুপ্তির গ্রাস থেকে ফিরে আসা কিউবান কুমির

পৃথিবী নামের গ্রহটাতে সরীসৃপদের রাজত্ব কোটি কোটি বছর ধরে, এখনো অনেক ভূখণ্ডে কেবল তাদেরই বাস। তাদের মধ্যে আবার কুমিরদের প্রতাপ একটু বেশি, এদের মধ্যে আবার কিউবান কুমির দখল করে আছে বিশেষ একটি স্থান, কারণ-এই প্রজাতির কুমির সবচেয়ে বেশি সময় ডাঙ্গায় অতিবাহিত করে, প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরের শরীর উজ্জ্বলতর বর্ণ ধারণ করে, এদের পা দেহের তুলনায় লম্বা, গায়ের আঁশ খসখসে, এরা প্রয়োজনে অনেক উঁচুতে লাফাতে পারে, দলবদ্ধ ভাবে শিকার করতে পারে যা অন্য কোনো কুমিরের ক্ষেত্রে শোনা যায়নি এবং সম্ভবত এরা সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতির কুমির!

ছোট আকৃতির এই কুমিরটি (পূর্ণবয়স্কদের গড় দৈর্ঘ্য ২,৪ মিটার) এককালে ক্যারিবিয় নানা দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করলেও বর্তমানে এর দেখা মেলে কেবলমাত্র কিউবার যাপাতার ম্যানগ্রোভ বনে এবং আইল্যান্ড অফ ইয়ুথ দ্বীপে।

সেই হিসেবে এটি অতিবিরল এক সরীসৃপ, বর্তমানে এই দুই জায়গায় বুনো পরিবেশে মাত্র ৩০০০ থেকে ৬০০০টি কুমির টিকে আছে। কিন্তু কয়েক দশক আগে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তির মুখে পড়ে কোটি কোটি বছর টিকে থাকা এই প্রাণীটি। মূল কারণ, বরাবরের মতই বাসস্থান ধ্বংস, মানুষের শিকার।

কয়েক দশক আগে ব্যাপারটি নজরে আসে কিউবান বিপ্লবের অন্যতম স্থপতি বর্তমান রাষ্ট্রপতি রাউল ক্যাস্ত্রোর। যাপাতা ম্যানগ্রোভ বনের কাছেই তার উদ্যোগে কিউবান সরকার স্থাপন করে কিউবান কুমির প্রজনন কেন্দ্র। বিলুপ্তির করাল গ্রাস থেকে ফিরে আসে অসাধারণ এই প্রাণীটি। ল্য সালিনাসের সেই কুমির প্রজনন কেন্দ্র গিয়ে শুনে আসি তাদের টিকে থাকার কাহিনি।
croc_1
ফার্মে ঢুকতেই প্রথমে টিকিট কাটতে হল অফিস থেকে, সেই সাথে সঙ্গী হিসেবে দেওয়া হল একজন গাইডকে, যিনি কুমির এবং এই প্রজনন কেন্দ্রের কর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। প্রথমেই এক জলজ উদ্ভিদে সমৃদ্ধ বিশাল পুকুর। পুকুরে উজ্জ্বল ফুল থেকে থেকে সৌন্দর্যছটা দিয়ে যাচ্ছে। কুমিরদের খাদ্যের ভাণ্ডারে মাছের স্তূপ। এর পরই জাল দিয়ে ঘেরা চৌবাচ্চা। তাতে কুমিরদের সাথে সাথে নানা ধরনের কচ্ছপের দেখাও মিলল। সারিসারি তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা খাঁচা, প্রতিটিতেই জল আছে পর্যাপ্ত, শুরু হল আমাদের কুমির প্রজনন কেন্দ্র দর্শন। প্রথমেই মাত্র কয়েক মাস বয়সী কুমির ছানা। এর পরে এক বছর বয়সী ছানাদের মহামেলা। একটু দূরের খাঁচায় ২ বছর বয়সীদের ভিড়, তারপরে ৩ বছর বয়সীরা। এমনভাবে বয়স অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে ভাগ করে রাখা হয়েছে এই সুদর্শন সরীসৃপদের।

সূর্যিমামাকে মাথার উপরে রেখেই চলছে আমাদের দর্শন, এর ফাঁকে এক শক্ত-পোক্ত গড়নের চাচামিয়া এসে বলল, কুমিরকে খাওয়াতে যাচ্ছি, দেখতে চাও নাকি? দেখব না মানে! মনে হল এরই অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ, বিশাল মাছের মুড়ো-লেজসহ ( পেটি ছাড়া, সেটি মনে হল অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়ে গেছে) দেহটা সেই সারি সারি পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল ঝাঁকের মাঝে পড়ার সাথে সাথে কি যে এক আলোড়নের সৃষ্টি হল, মনে হল কুমিরের এক বিশাল পাহাড় নির্মিত হয়েছে অজানা মন্ত্রবলে, সেই পাহাড় আবার চলমান!আর মাঝে থেকেই কোন চতুর কুমির কুশলী রাগবি খেলোয়াড়ের মত পাকা ডজ দিয়ে বেরিয়ে এল হুটোপুটি থেকে, মুখে ধরা মাছ নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে, প্রায় দৌড়ে অন্যদের নাগালের বাইরে যেয়ে পড়ল জলের মাঝে!

গাইডের কাছে থেকে জানা গেল লম্বা পায়ের রহস্য, এই প্রজাতির কুমিরের আদিপুরুষদের খাদ্যতালিকায় ছিল বিশালদেহী স্থলচর স্লথ, তাদের কাবু করতেই দ্রুতগতিতে দৌড় ও আক্রমণ করা শিখতে হয় তাদের, আর কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের পরে তারা পৌঁছায় আজকের পর্যায়ে।
croc_2
শুনলাম, এখন এই প্রজাতিটি বিলুপ্তি আশঙ্কামুক্ত। কেবল মাত্র কিউবান সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নিবিড় পরিচর্যার জন্য (এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল বাগেরহাটের খানজাহান আলির কুমিরগুলোর কুশিক্ষিত লোভী মানুষের খপ্পরে পড়ে আফিম খাইয়ে মারার ঘটনাটি) । কিন্তু এখনো চিন্তার মূল বিষয় হচ্ছে কিউবান কুমিরের মোট জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ২ ভাগ পুরুষ! তার মধ্যে এক ভাগ আছে জলাভূমিতে মুক্ত পরিবেশে, আর ১ ভাগ আছে এই প্রজনন কেন্দ্রে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই অনুপাত বৈষম্য দূর করতে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সফলতা ধরা দিচ্ছে না। কিন্তু আশা করতে পারি আমরা, যে গবেষণা ও পরিচর্যা এমন অসাধারণ একটি প্রজাতিকে সাক্ষাৎ বিলুপ্তির অন্ধকূপ থেকে তুলে এনেছে, তারা নিশ্চয়ই রক্ষা করবে এদের টিকে থাকার অধিকার।

ফেরার পথে দেখা গেল প্রজননকেন্দ্রের আরেক আকর্ষণ, কুমির ও কুমিরজাতদ্রব্যের দোকান! এখানে কুমিরের দাঁত, হাড়, চামড়া দিয়ে প্রস্ততকৃত নানাবিধ পণ্যের সাথে কুমিরের বাচ্চা পর্যন্ত বিক্রি হয় (একটি বাচ্চার দাম ২০০ ডলার)। তবে এখানে কেবলমাত্র নানা কারণে মৃত অথবা পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ কুমির ব্যবসার খাতিরে বিক্রি করে সেই অর্থায়নে প্রজননকেন্দ্র চালানো হয়। ফটকের কাছেই মিলল আরেক প্রস্তাব, এখানে গোটাকয়েক হোটেলে কুমিরের মাংসের স্বাদ মিলতে পারে, সেই সাথে দুর্লভ এই আমিষ সস্তাগণ্ডায় উদরপূর্তি করতে চাইলে স্থানীয় কিছু বাড়িতে গেলেও চলবে, পাতে ভাত, আলু, মুরগীর সাথে পড়বে খাঁটি কুমিরের মাংস! সর্বভুক মানুষ আমি, কিন্তু বুনোপ্রাণী খেতে মন কখনোই সায় দেয় না, হোক না সেটা আইনের মধ্য থেকে শিকার করা। তাই এ যাত্রা হোটেলে ফেরা।

আশা করি, বাংলাদেশেও বিলুপ্তি সাথে লড়তে থাকা কিছু প্রাণীকে আমরা এভাবেই রক্ষা করতে পারব, বুনো পরিবেশে।

লেখক : পর্যটক, ভ্রমণ-লেখক।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।