ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

যান্ত্রিক নগর ছেড়ে...

রফিকুল ইসলাম সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৮ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৪
যান্ত্রিক নগর ছেড়ে... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ভ্রমণের মাঝে লুকিয়ে থাকে নানা অভিজ্ঞতার কথা। অনেকেরই নানা দেশ-স্থান ভ্রমণের আগ্রহ থাকলেও আমার আগ্রহটা অন্যরকম।

নতুন দেশ, জায়গা তো বটেই তার চেয়ে বেশি উপভোগ করি এর যাত্রাটা। তাও আবার ট্রেনে।  

অন্য সব যানবাহনে ভ্রমণের চেয়ে ট্রেন ভ্রমণের মজাটা অন্যরকম। দেশে এবং বিদেশে অসংখ্যবার ট্রেনে উঠেছি। একেক দেশে ট্রেনের একেক নাম। ট্রেনেগুলোর আকারও একেক রকম। আর এর নামগুলো মূলত সেসব দেশের স্থানীয় ভাষায় হয়।

আমার জীবনের স্মৃতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে ট্রেন ভ্রমণের স্মৃতি। ট্রেনের ঝকঝক শব্দ, যানজট বিহীন পথ। ট্রেন লাইনের দু'পাশে সারি সারি গাছ। যেনো আশপাশের বাড়িঘর সব কিছুকে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে ট্রেন তার আপন গন্তব্যে।

ছোটবেলা থেকেই আমার ভ্রমণের নেশা। কোথাও ভ্রমণে যেতে ট্রেনকে বেছে নেই সবার আগে। ট্রেন ভ্রমণের অসংখ্য অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। চোখের সামনে ঘটেছে অনেক ট্রেন দুর্ঘটনা। সময় মতো গন্তব্যে না পৌঁছানোর কারণে অনেক রাত কাটিয়েছি রেল স্টেশনে। এছাড়া ট্রেনের সময়সূচি বিলম্ব হওয়ার কারণেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে রেল স্টেশনে।

এবার আমাদের গন্তব্য ছিলো গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে। শরীফ ভাই আগের দিন বলে রেখেছিল শ্রীপুর যাওয়ার কথা। পরের দিন দুপুরে শরীফ ভাই ফোন করে বলল, বিকেল সাড়ে চারটায় ট্রেন। তিনটের মধ্যে আমাদের স্টেশনে যাওয়ার জন্য বের হতে হবে। যথাসময়ে বিমান বন্দর স্টেশনে পৌঁছলাম।

স্টেশনে অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি ভিড়। মে দিবস এবং দুইদিন সরকারি ছুটি মিলিয়ে একসাথে তিনদিন ছুটি পেয়ে সবাই নিজ নিজ গাঁয়ে ফিরছে। সবার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। এ আনন্দ আপন মানুষদের সাথে মিলিত হওয়ার।

কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে ট্রেনের জন্য দশ মিনিট অপেক্ষা করতেই মাইকে ঘোষণা শুনতে পেলাম, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দেওয়ানগঞ্জগামী জামালপুর কমিউটার স্টেশনে আসবে। মাইকে ঘোষণা শুনতে পেয়ে ট্রেনে ওঠার প্রস্তুতি নিলাম। কয়েক মিনিট পর জামালপুর কমিউটার স্টেশনে দাঁড়ালো।

ট্রেনের প্রতিটি বগিতে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখতে পেলাম। এই ভিড়ের ভেতরেই আরও যাত্রী ঠাসাঠাসি করে ট্রেনে উঠছে। শরীফ ভাই আমাকে বলল, কিরে কি করবি? কিভাবে যাবি? আমি বললাম, চলো ছাদে উঠি। শরীফ ভাই প্রথমে আপত্তি করলো। পরে দু'জনেই ট্রেনের ছাদের উপর উঠলাম। ছাদের উপরেও জায়গা নেই। কোনরকম চাপাচাপি করে বসলাম।

এই ভিড়ের মধ্যেই ছাদের উপর হকাররা নানা রকমের খাবার বিক্রি করছে। কেউ ডিম, কেউ পান-সিগারেট, কেউ চানাচুর-সিঙ্গারা। হকারগুলো চলন্ত ট্রেনেই ছাদের উপর হেঁটে এক বগি থেকে অন্য বগি লাফিয়ে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটার বিন্দুমাত্র ভয় নেই তাদের। ছাদের উপরেও একজন এলো টিকেট চেক করতে।

এয়ারপোর্ট স্টেশনের পর টঙ্গী, এরপর জয়দেবপুর ক্রস করে ভাওয়াল স্টেশন। ভাওয়াল অতিক্রম করার পরই চলন্ত ট্রেন থেকে বাম দিকে গায়ের খোলা মাঠে মেলা দেখতে পেলাম। ক্ষণিকের দৃষ্টিতে রঙিন পোশাকে ছোট বড় অনেক মানুষ মেলায়।

সব স্টেশনের চেহারাই কেমন যেনো এক মনে হয় আমার কাছে। তবে দেশের বাইরের রেল স্টেশনগুলোতে আমাদের দেশের মতো চা স্টল নেই। এছাড়া সেসব রেল স্টেশনগুলো অনেক পরিষ্কার পরিছন্ন। পাশাপাশি টিকেটিং সিস্টেমও অনেক উন্নত। সব কিছু অটোমেটিক ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে হয়। যে কারণে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের কোনো সুযোগ নেই। রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণ প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিছুক্ষণ পরপর চায়ের দোকানে গিয়ে চা পান করা, প্ল্যাটফর্মে বসে বসে অপেক্ষা করা, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, নানা রকমের ঘটনা সেই মুহূর্তগুলো ছিল আমার জীবনের ভালো কিছু মুহূর্ত। ট্রেন স্টেশন ও পার্শ্ববর্তী দৃশ্যগুলোতে যেনো ডুবে যাই আমি।

ঝক ঝক শব্দে ট্রেন চলছে। রেল লাইনের দু'পাশে সারি সারি গাছ। কখনো কখনো গাছের ডাল-পাতা শরীরে আঘাত লাগার আশঙ্কায় মাথা উঁচু-নিঁচু করতে করতে রাজেন্দ্রপুর স্টেশন অতিক্রম করলাম। এ রাস্তায় লাইনের দু'পাশে গাছের সংখ্যা আরো বেশি। একটু দূরে ঘন গজারী বন। বনের ভিতরে ইটের রাস্তা দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। তারকাটার বেড়া দিয়ে বনগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা। কখনো আবার লাইনের দু'পাশে কলা বাগান, বাঁশ বাগান। কোথাও আবার খালি ময়দান, ধানক্ষেত, পুকুর এসব দৃশ্য হৃদয় বন্দী করে পৌঁছে গেলাম শ্রীপুর স্টেশনে।

ট্রেন থেকে নেমে আমি খুব আফসোস করলাম অনেক দ্রুত চলে এলাম বলে। ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের আনন্দটা একেবারে অন্যরকম। এডভেঞ্চারে ভরপুর।

শ্রীপুর স্টেশনের বাজারে একটি চায়ের দোকানে হাতমুখ ধুয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। গরুর দুধের চা। শরীফ ভাই বলল, এখান থেকে বেশি কিছু খাবি না! সামনে গিয়ে তোকে একটি হোটেলে পুরি খাওয়াব। এমন মজাদার পুরি তুই আর কোথাও পাবি না।

পুরি খেয়ে বুঝলাম শরীফ ভাই এই পুরির এতো সুনাম কেন করলেন। এমন পুরি আসলেই অন্য কোথাও খাইনি আমি, এর   ভেতরের মসলা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার শুধু পুরি-ই না পিয়াজু ও আলুর চপও মজাদার।

ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন জীবনের প্রথম স্কুল ফাঁকি দিয়ে দু'জন বন্ধু ট্রেনে করে চলে গিয়েছিলাম ঘোড়াশাল রেল স্টেশনে, তখন থেকে ট্রেন ভ্রমণের নেশা আমাকে জেঁকে ধরে। তারপর থেকে আর থেমে নেই। যখন-তখনই অনির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যেতাম ট্রেনে করে। স্টেশনে গিয়ে সময় সূচি দেখতাম। স্টেশন পৌঁছানোর পর কাছিকাছি সময়ে যেই ট্রেন আসতো সেই ট্রেনেই উঠে পরতাম।

ছোটবেলায়ও ট্রেন ভ্রমণ করেছি, তবে বাবা-মায়ের সাথে। আগে ট্রেনে ভ্রমণ করতাম প্রয়োজনে। আর এর পর থেকে ভ্রমণ করাটা নেশায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি রেলস্টেশন আমার পরিচিত, প্রায় রেলের সব তথ্যই আমার জানা। এমন অনেকবার হয়েছে, সকালের ট্রেনে যেতাম আবার রাতে আরেক ট্রেনে ফিরে আসতাম। মূল উদ্দেশ্যই ছিল শুধু ট্রেনে ওঠা।

দিনের চেয়ে রাতে ট্রেন ভ্রমণটা বেশি উপভোগ্য। আর যদি রাতটা চাঁদনি রাত হয় তো কথাই নেই। আধো রূপালি আলোয় একটার পর একটা দৃশ্য ছুটে যায়, পেছনের দিকে। দৃশ্য থেকে দৃশ্যপটের বদল হয়।

মনটা কেমর যেনো খুব অদ্ভূত ভাবে আবেগি হয়ে যায়। নিজের সঙ্গে নিজেরই  কথা হয় তখন। সব কিছুই দেখা যায়, আবার ভালো করে দেখতে গেলে কোনো কিছুই ঠিকমতো দেখা যায় না। কেবল কল্পনায় আবিষ্কারের চেষ্টা ওখানে কী ‌আছে।   

ভ্রমণে গিয়ে পকেটের টাকা ফুরিয়ে গেলে বাড়ি ফেরা নিয়ে ভয় পেতাম না। ট্রেনে টিকেট ছাড়া, ভাড়া ছাড়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও আমার নেহাত মন্দ নয়।

স্কুলে পড়াকালীন আমি বাড়ির কাউকে কিছু না বলে ট্রেনে করে দূর দূরান্তে চলে যেতাম। তখন ট্রেনের ছাদে বসে যেতে আমার বেশি ভালো লাগতো। তাই নির্দিষ্ট গন্তব্যের টিকেট কিনেও লোকাল ট্রেনের ছাদে বসে যেতাম। এখন আর ছাদে বসে যাওয়ার মতো পাগলামি তেমন একটা করা হয় না।

যা হোক, আমরা রাত যাপন করলাম শরীফ ভাইয়ের ফুফুর বাড়িতে। রাতে প্রচণ্ড রকমের ঝড় এবং তার সাথে বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ সাথে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ঘুম ভালো হয়েছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা শেষে গেলাম তাঁতিসুতা গায়ে। ঘড়ির কাটায় তখন বেলা ১১টা। নতুন বাজার থেকে হেঁটে গাঁয়ের পথে ধরলাম। মাটির কাঁচা পথ। একটু সামনের দিকে যেতেই দু’পাশে দিগন্ত প্রসারী ঘন সবুজ ফসলের মাঠ। দক্ষিণা বাতাসে দোল খায় সোনালী ধান ক্ষেত।

 কিছু কিছু ধান গাছ ঝড়ের আঘাতে শুয়ে গেছে। আরেকটু সামনে দেখতে পেলাম কৃষকেরা ধানের আটি থেকে ধান ঝাড়ছে। ততক্ষণে শরীফ ভাইদের গাঁয়ের বাড়িতে চলে এসেছি। বাড়ির একটু আগে পথে ছোট ছোট দুই-তিনটা আমগাছ চোখে পড়ল। যেগুলোতে আম ঝুলছে। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম উঠানে ধান শুকাতে দেওয়া। সবগুলো মাটির ঘর। বাড়ির চারপাশ আম, কাঁঠাল, আমড়া, তাল, খেঁজুর গাছের ছায়ায় ঘেরা। আম গাছে আম, কাঠাল গাছে কাঁঠাল, খেজুর গাছে খেজুর, তাল গাছে ছোট ছোট তালের আঁটি ঝুলছে।

কাঁচা আম পাড়তে বাড়ির পিছনে গেলাম। শরীফ ভাই বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে আম ফেলল আর আমি কুঁড়ালাম। আম পাড়া শেষে আমাদের বেল পাড়া কর্মসূচি। গাছে ওঠার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাঁটার জন্য উঠতে পারলাম না। অবশেষে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শরীফ ভাই বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে বেল পাড়তে লাগলেন।

এবার দু’জনে দা’ হাতে নিয়ে নারিকেল বাগানে গেলাম। সেখানে গিয়ে পেলাম শরীফ ভাইয়ের চাচাতো ভাই ফরহাদকে। নারিকেল বাগানে নারিকেল গাছের পাশাপাশি আমের গাছও দেখা গেল। আমি ছোট একটি নারিকেল গাছে উঠলাম। কিন্তু ডাব পারতে পারলাম না। উপরে উঠেই শরীরে ক্লান্তি অনুভব করে নেমে পড়লাম। পরে ফরহাদ ছয়টা ডাব পারলো।

নারকেল বাগানের ছায়ায় বসলাম কিছুক্ষণ, পাখিদের কিচির-মিচির, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাতাস মনে চরম শান্তি অনুভব করলাম। দুপুরে খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম শেষে এবার আবার যান্ত্রিক নগরে ফেরার পালা। এমন শান্ত-শ্যামল পরিবেশ ছেড়ে যদিও ফিরতে চাইছিল না মন তারপরেও...।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- bntravellers.notebook@gmail.com এই ঠিকানায়।


লেখা ও ছবি: রফিকুল ইসলাম সাগর

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪ ঘণ্টা, জুন- ০১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।