ঢাকা: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্রিটিশ এমডি কাইল হেউডের বিরুদ্ধে তার বেতনের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। আর এই ঘটনায় তোলপাড় চলছে গোটা বিমানে।
এদিকে, বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে কাইল হেউড গত বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন।
হুন্ডি কেলেংকারি ছাড়াও গোপনে বিদেশ সফর ও দু’জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে হেউডের বিরুদ্ধে।
এই ঘটনায় বিমানের শীর্ষ কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। পর্ষদের পরবর্তী বৈঠকে এ নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে বলেও আশংকা করা হচেছ। এমনকি হেউডের ঢাকা ফেরা নিয়েও দেখা দিয়েছে আশঙ্কা।
পর্ষদের দু’জন প্রভাবশালী সদস্য কাইলের এহেন কেলেংকারিকে খুবই স্বাভাবিকভাবে উড়িয়ে দেওয়ার কৌশল নেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। বলা হচ্ছে, মূলত এই দু’জনের অদৃশ্য মদদেই কাইল একের পর এক অপকর্ম করেও থেকে যাচেছন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এ ক্ষেত্রে সামনে আসছে- বিমানের প্রথম বিদেশি এমডি কেভিন স্টিল যদি বৈধভাবে বেতনের টাকা উত্তোলনের পর নিজ দেশে পাঠাতে সক্ষম হন, তাহলে কাইল হেউড কেন তা করেননি? কারা তাকে এমন গুরুতর অপরাধে নেপথ্য সহযোগিতা করেছেন? সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বিমানের প্রশাসন শাখার একজন কর্মকতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, কাইলের এ কেলেংকারি ফাঁস হবার পর থেকেই বিমানের কার্গো শাখার জিএম আলী আহসান বাবু ও জ্দ্দোর স্টেশন ম্যানেজার আবু তাহেরের নাম সামনে এসেছে।
বিমানের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, জিএম আলী আহসান বাবু ও জেদ্দার আবু তাহের নিজেদের দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে কৌশলে কাইলের বেতনের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে বিকল্প পথে দেশের বাইরে পাঠাতে সহায়তা করেন।
এদিকে, বিমানের প্রশাসন শাখা থেকে জানা যায়, কাইলের সঙ্গে আলী আহসান বাবু ও আবু তাহেরের এত ঘনিষ্টতার নেপথ্যে রয়েছে আরও এক কেলেংকারি।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি কার্গো শাখা থেকে লন্ডনের একটি ফ্লাইটে জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে তিন টন অতিরিক্ত কার্গো মাল পাঠানোর ঘটনা ফাঁস হয়। যে ঘটনা বর্তমানে তদন্ত করছেন ডিজিএম ওয়াদুদ। তদন্তে বার বার বাবুকে ডাকা হলেও তিনি কার্গো কেলেংকারির কোন সঠিক জবাব দিতে পারছেন না। একইভাবে জেদ্দায় কর্মরত তাহেরের বিরুদ্ধে বিমানের তহবিল আত্মসাতের মতো সুনির্দিষ্ট দুনীর্তির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হবার পর তাকে প্রত্যাহারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয় বোর্ড থেকে। কিন্তু কাইল হেউড তাকেও আনতে রাজী হননি। উল্টো যুক্তি দেখাচেছন, তাহেরের মতো এমন দক্ষ ও গুণী কর্মকর্তা সারা বিমানে নেই। তাকে প্রত্যাহার করা হলে জেদ্দা স্টেশন অচল হয়ে যাবে।
বিমান সংশ্লিষ্টরা এ ধরণের যুক্তিকে হাস্যকর ও খোঁড়া বলে মনে করছেন আর তা নিয়ে বিমানে গুঞ্জন ওঠেছে, কেন বাবু ও তাহেরের প্রতি কাইলের এত দুর্বলতা!
বলা হচ্ছে, বাবু ও তাহেরের মতো চিহ্নিত দুই দুর্নীতিবাজকে প্রত্যক্ষ মদদ দেওয়ায় হুন্ডি পাচারে কাইলকে সহযোগিতার অভিযোগ অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
বিমানের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে বেতনের টাকা সবটাই বিদেশে পাঠানোর কাজে যারা তাকে গোপনে সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করার দাবি জোরালো হচেছ।
ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অন্য যে কোন পথে দেশের বাইরে টাকা পাঠালে তা হুন্ডি ও অর্থপাচারের মতো অপরাধের সামিল, এমনটাই বলা হয়েছে প্রচলিত আইনে।
এ সব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমানের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান বাংলানিউজকে বলেন, ‘শুধু বিমানের এমডি কেন, অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে কোন বিদেশি নাগরিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
তিনি জানান, এর আগে এ ধরণের অভিযোগে ঢাকায় ইরাক ও কোরিয়ার দুইজন নাগরিককে আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা।
বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি নাগরিক বাইরে যাওয়ার সময় সর্বোচ্চ ৫ হাজার ডলার নিতে পারেন। প্রশ্ন উঠতে পারে- তাহলে কি প্রতি সপ্তাহেই যদি বিদেশ যান, পাঁচ হাজার ডলার সঙ্গে করে নিতে পারবেন? অবশ্যই নয়! কোন নাগরিক এক বছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার সঙ্গে নিতে পারবেন, বলেন এই কর্মকর্তা।
বিমানের এ ঘটনা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে বলেও মত দেন ডক্টর মইনুল খান।
বিমানের ব্রিটিশ এমডি কাইল হেউডের বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠানো, ছুটি ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ ও গত সাত মাসে ৫০ দিনের বেশি বিদেশে থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৯২ লাখ ৩৭ হাজার টাকা বেতন হিসেবে উত্তোলন করেছেন বিমান থেকে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াই পুরো টাকা তিনি নিয়েছেন নগদ অর্থে। আর এর বড় অংশই তিনি গোপণে লন্ডনে পাঠিয়েছেন অবৈধ পথে। কঠোর নিয়ম-কানুন থাকায় কোনো টাকাই তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাননি।
দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নিয়োগ পাওয়ার ৭ মাস তার কোনও ব্যাংক অ্যাকাউন্টই ছিলো না। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন।
এ সব বিষয়ে বিনিয়োগ বোর্ড বলছে, যে কোনো বিদেশি নাগরিকের অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে। এর বাইরে টাকা পাঠালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তা অপরাধ।
একই কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। গত এক বছরে কাইলের বেতন অনুমোদন করা হয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার ২১৭ ডলার। প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি ৬০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে প্রতি মাসে তার বেতন দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আর এই বেতনের ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি মাসে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তিনি বৈধ পথেই দেশে পাঠাতে পারেন।
নিয়োগের সময় দেশের প্রচলিত বিধান অনুসারে আয়কর প্রদান এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ আইনসহ দেশের বিদ্যমান সব ধরনের আইন মেনে চলার শর্তও দেওয়া হয় কাইলকে।
নগদ অর্থ নিয়ে অবৈধ পথে তা দেশে পাঠিয়ে এসব শর্তের ব্যত্যয় করেছেন কাইল।
এদিকে, আরও একটি গল্প চাউর হয়ে পড়েছে বিমানে। জানা গেছে, এমন পরিস্থিতিতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেছেন আরেকজন প্রভাবশালী পরিচালক। আগামী ১০ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে এই পরিচালকের। অভিযোগ উঠেছে অবসরে যাওয়া ঠেকাতে ওই পরিচালক কাইলের বিরুদ্বে ওঠা অভিযোগকে পূঁজি করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। অবসরে না গিয়ে আগেই চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ বৃদ্ধির পায়তারা করছেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৫
এমএমকে