ঢাকা: ‘রাষ্ট্র এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের একসঙ্গে চলতে হবে। রাষ্ট্র যদি রিজিট হয়ে থাকে, তাহলে পর্যটন খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়’।
‘বাংলাদেশের তুলনায় সিঙ্গাপুর কিছুই না। কিন্তু তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর অনেক সম্ভাবনা থাকলেও আমরা সেগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না’।
বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সম্ভাবনা নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন শাহ মেরিন অ্যান্ড বিজনেস ইন্সটিটিউট ও আফরোজ শিপিং লাইনের চেয়ারম্যান মাকসুদা আফরোজ চৌধুরী। তার কোম্পানি আফরোজ শিপিং বাংলাদেশে প্রথম পাঁচ তারকা মানের প্রমোদতরী আনতে যাচ্ছে। সবকিছু চূড়ান্ত করেও বসে আছে বন্দরের অবকাঠামো সংকটের কারণে।
মাকসুদা আফরোজ চৌধুরী বলেন, আমাদের বিশাল সাগর রয়েছে। কিন্তু সেই সাগর দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমরা শুধু সৈকত নিয়ে বসে আছি। পূর্ণিমা দেখতে হলে সাগরের বিকল্প নেই। রাতের বেলা তারাগুলো যে কতো সুন্দর দেখায়, তা সাগরে না গেলে অনুমান করা কঠিন। বিশ্বের অনেক দেশেই পূর্ণিমা উপভোগ করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমরা এখনও পিছিয়ে রয়েছি।
তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই সাগর ভ্রমণের জন্য প্রমোদতরী রয়েছে। স্বাধীনতার এতোদিন পরও বাংলাদেশে প্রমোদতরী চলার স্বপ্নই থেকে গেছে। আমরা সাগরে ভ্রমণের জন্য ফাইভ স্টার মানের প্রমোদতরী আনার সব ব্যবস্থা পাকা করেছি।
ওই জাহাজে থাকবে ৫টি ফাইভ স্টার মানের হোটেল সেবা। থাকবে সুইমিং পুল, থ্রি-ডি হল, লাইভ প্রোগ্রামের জন্য হলরুম, জিম, বাদ যাবে না বিউটি পার্লারও। এ জন্য প্রথম দফায় সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে আনা হবে এক্সপার্ট কর্মী। তাদের সঙ্গে থেকে প্রশিক্ষিত হবেন বাংলাদেশিরাও, যারা পরবর্তীতে জাহাজটি পরিচালনা করবেন।
‘আমাদের এই শিপটি হবে মুভিং ফাইভস্টার সিটি। কিন্তু সেই শিপটির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোর উন্নয়ন করা প্রয়োজন। অনেকদিন ধরেই কথা চলছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও আফরোজ শিপিং ও চট্টগ্রাম পোর্টের সমন্বয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। আমরা নিজেরাই বিনিয়োগ করে বন্দরের ডেভেলপ করতে চাই বলেন মাকসুদা আফরোজ চৌধুরী।
বন্দরের কোন ধরনের উন্নয়ন প্রয়োজন? এমন প্রশ্নের জবাবে মাকসুদা আফরোজ বলেন, জাহাজটিতে দুই হাজার লোক ভ্রমণ করবেন। তাদের অনেক লাগেজ থাকবে। সেগুলো তো আর হাতে হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। এ জন্য বিমানবন্দরের মতো লাগেজ সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে। না হলে লাগেজজটে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। ভ্রমণে বের হয়ে দুর্ভোগ হলে সেই ভ্রমণে কেউ যেতে চাইবেন না। তাই লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের উন্নয়ন করতে হবে।
শিপ ছাড়া বঙ্গোপসাগরকে তুলে ধরার কোনো সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন আফরোজ শিপিংয়ের চেয়ারম্যান।
মাকসুদা আফরোজ বলেন, আপনি ইংল্যান্ডে যান, তাদের কি স্যান্ডি বিচ আছে? নেই। তারা কৃত্রিম স্যান্ডি বিচ তৈরি করেছে। আর আমাদের বিচ কতো সুন্দর। রয়েছে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। কিন্তু সৈকতকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে আমাদের। আমারতো মনে হয়, কোনোই পরিকল্পনা নেই। রাতে লোকজন সেখানে যেতে ভয় পান। নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। তাহলে মানুষ কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে এখানে কেনো আসবেন?
তিনি বলেন, আমাদের বিচে সাগর দেখা ছাড়া আর কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। বিচের পাশে থাকবে ওপেন ডিজে, থাকতে পারে অপেশাদার মিউজিশিয়ানদের জন্য মঞ্চ। যাদের ইচ্ছে হবে সেখানে গিয়ে আনন্দ করবেন। পাশেই থাকা উচিত শিশুদের জন্য পার্ক। তাহলে এতে আগ্রহী হবেন পর্যটকরা।
‘আমাদের বিচে গেলে যদি কারো ফ্রেসরুমে যাওয়ার প্রয়োজন, সেখানে কি সেই ব্যবস্থা আছে? নেই। ফ্রেসরুমের জন্য ফিরে যেতে হবে হোটেলে। সরকার নিজে এসব ব্যবস্থা করতে পারে। আবার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দিয়েও করাতে পারে। কিন্তু না সরকার নিজে করছে, না অন্যদেরকে করার অনুমতি দিচ্ছে। সেখানে ভ্রাম্যমাণ টয়লেট থাকতে পারে’ বলেও মতামত দেন মাকসুদা আফরোজ।
তিনি বলেন, দেখেন, আমাদের রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি এলাকার সৌন্দর্য। কিন্তু সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো উপায় আছে। নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট ছাড়া অনেক এলাকাই এখনও রয়েছে অজানা। পাহাড়ি এই এলাকাটিতে আমরা ক্যাবলকার বসাতে চাই। যাতে উঠে দর্শনার্থীরা উপভোগ করতে পারবেন নয়নাভিরাম রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়িকে। কিন্তু সেখানে ব্যারিয়ার দিয়ে রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, রাঙ্গামাটির স্থায়ী বাসিন্দা না হলে জমি কেনা যাবে না।
‘আমরাতো জমি চাই না। সরকার আমাদের লিজ দিক। না হলে পিপিপির আওতায় ক্যাবল কার স্থাপনের সুযোগ দিক। দেখবেন, অনেক পর্যটক বেড়ে যাবে। ক্যাবলকার দুর্গম এলাকায় দেখার সুযোগ তৈরি করে দেবে। পর্যটনের বিশাল দ্বার উন্মোচিত হবে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ক্যাবল কারেতো বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে, আফরোজ শিপিং কি তার যোগান দিতে পারবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিনিয়োগ কোনো সমস্যা নয়। অনেক প্রবাসী ভালো প্রজেক্ট খুঁজছেন বিনিয়োগ করার জন্য। অনেকের সঙ্গে এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। সরকার আন্তরিক হলেই হয়।
তিনি বলেন, বিদেশি অতিথি এলে কষ্ট লাগে কোথায় নিয়ে যাবো। অথচ আমাদের গর্ব করার মতো অনেক কিছু রয়েছে। সবগুলোই পড়ে রয়েছে অনাদরে। আমরা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি বারবার।
মাকসুদা আফরোজ নিজে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। বিশ্বাস করেন, দেশ একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত হবে। এই স্বপ্নচারীর জন্ম টাঙ্গাইল জেলার সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাবার চাকরির কারণে কুয়েতে প্রবাস জীবন শুরু করেন। সেখান থেকেই বাংলাদেশি সিলেবাসে পড়ালেখা করেন। বাবা-মাই ছিলেন তার প্রধান শিক্ষক। সারা বছর তাদের কাছে শিখতেন। আর বছর শেষে দেশে আসতেন পরীক্ষা দিতে।
খিলগাঁও গর্ভমেন্ট কলেজ থেকে সফলতার সঙ্গে এসএসসি ও সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ইডেন কলেজে। সেখান থেকে সম্মানসহ ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজ জীবন বলতে তার সম্মান শ্রেণিতে এক বছর। ওই বছর তিনি নিয়মিত ক্লাস করার সুযোগ পান।
২০০১ সালে বৈবাহিক সূত্রে চলে যান লন্ডনে। সেখানে এইচএসবিসি ব্যাংকের নর্থ-ইস্ট শাখায় চাকরি নেন। কিন্তু গৎবাঁধা চাকরি তার মনে ধরেনি। ইচ্ছা ছিলো নিজেই কিছু করার। শুরু করেন ব্যবসা। শাহ হোমস লেটিং এজেন্সি দিয়ে ব্যবসায় পথচলা শুরু। এরপর ট্রাভেলস, এয়ার টিকেটিংয়ের ব্যবসা শুরু করেন লন্ডনে বসেই।
ব্যবসা সূত্রে যোগাযোগ হয় বিশ্বখ্যাত সাউথ-টাইন-সাইড কলেজের সঙ্গে। স্বপ্ন দেখেন কলেজটির শাখা খোলার জন্য। লক্ষ্য বাংলাদেশে দক্ষ মেরিনার তৈরি করা। প্রস্তাব দিলে দ্রুতই অনুমোদন পেয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে ২০০৮ সালে দেশে ফিরে ঢাকার শ্যামলীতে চালু করেন শাহ মেরিন অ্যান্ড বিজনেস ইন্সটিটিউট।
এখন পর্যন্ত তার কলেজ থেকে তিনটি ব্যাচ বেরিয়ে গেছে। যাদের অনেকেই বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন। যাদের একেকজনের বেতন বিদেশ যাওয়া ১০ জন অদক্ষ শ্রমিকের চেয়েও বেশি। এমন অনেকে রয়েছেন, যারা মাসে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন সম্ভাবনা রয়েছে। তার কলেজ শুধু সনদ দিয়ে বসে থাকে না। শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য সব সময় সচেষ্ট থেকেছেন। যে কারণে কলেজটির সুনাম এখন দেশজুড়ে।
মাকসুদা আফরোজ আক্ষেপ করে বলেন, সারা বিশ্বে নাবিকের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে পাস করা কিছু শিক্ষার্থী নাকি চাকরি পাচ্ছেন না। তাদের আন্দোলনের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এই খাতে। চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি ২শ’ ছাত্র ভর্তি করাতো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাছাই করে। সেই চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিই এখন ছাত্রই পাচ্ছে না। আন্দোলন দেখে অন্যরা ভয় পেয়ে এ বিষয়ে পড়তে আসতে চাচ্ছেন না। যে কারণে আমাদেরও শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিয়েছে।
আপনি বলছেন, নাবিকের অনেক চাহিদা রয়েছে। তাহলে তারা চাকরি পাচ্ছেন না কেনো?- জবাবে মাকসুদা আফরোজ বলেন, আমি বলবো, তারা চাকরির বাজার খোঁজ করেননি যথাযথভাবে। একটু চোখ কান খোলা রাখলে তাদের চাকরি পেতে সমস্যা হওয়ার কথা না।
তিনি দু:খ করে বলেন, চট্টগ্রামের ওই শিক্ষার্থীরা মেরিন একাডেমির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েট থেকে পাস করা কোনো শিক্ষার্থী কি চাকরি না পেয়ে তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন? তাহলে মেরিন একাডেমির বিরুদ্ধে কেন এই আন্দোলন? এর রহস্য তলিয়ে দেখা দরকার।
একাডেমিক শিক্ষার বাইরেও মাকসুদার পদচারণা অনেক বিস্তৃত। কম্পিউটার প্রোগামিং, ওয়েব ডিজাইন, থ্রি-ডি এনিমেশন, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তিনি। তার হাতের ছোঁয়ায় বাস্তবরূপ পেয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইট।
অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে চলছেন। মাঝে মাঝে হতাশা ভর করে তাকেও। কিন্তু আবার দ্বিগুণ আশা নিয়ে কাজে মনযোগী হয়েছেন। স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশ একদিন সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে। কারণ, তাদের চেয়ে অনেক বেশি কিছু রয়েছে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৬
এসআই/এএসআর