কালের বিবর্তনে বদলে গেছে ‘ভয়ঙ্কর’ সেই ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই রোড। অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকলেও ওই এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল বিরল।
অন্যদিকে পুরনো সাপ্লাই রোড এলাকার দুর্নামকে ছাপিয়ে গেছে নগরের টিলাগড়। মহানগরের মধ্যে ‘ডাকাত প্রবণ’ এলাকাখ্যাত টিলাগড়ে ছিল কুখ্যাত মজিদ ডাকাত, ক্রস ফায়ারে মারা যাওয়া জমসেদ ডাকাতের আস্তানা। মাদকের দিক থেকেও দুর্নাম কুড়িয়েছে এলাকাটি। কুখ্যাত হেরোইন ব্যবসায়ী কবির ওরফে হেরোইন কবিরের আস্তানাও টিলাগড়ে।
ওই এলাকার শাপলাবাগ থেকে সপরিবারে গ্রেফতার করা হয় দেশ কাঁপানো শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়েখ রহমানকেও। এই টিলাগড় এলাকা ঘেঁষা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ও সরকারি কলেজ। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর অবস্থান। এ কারণে এলাকাটি ‘শিক্ষাপাড়া’ হিসেবে পরিচিত। এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতার দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। বিগত দশ বছরে এই দ্বন্দ্বের বলি হয়েছেন ছাত্রলীগের অন্তত ১০ নেতাকর্মী, যাদের সবাই শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্ষমতাসীন দুই নেতার বলয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে অনেকবার। নোংরা গ্রুপিং রাজনীতিতে পড়েছে কেবল শিক্ষার্থীদের লাশ। ফলে মানুষের কাছে ‘শিক্ষাপাড়ার’ পরিবর্তে ‘কিলিংস্পটের’ দুর্নাম কুড়িয়েছে টিলাগড়।
ওই এলাকায় লাশ পড়লেই সারা দেশের নজর কাড়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসা কোনো শিক্ষার্থীর প্রাণ গেল- সেই খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন আতঙ্কিত অভিভাবকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে ছাত্রলীগের কোন্দলে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী উদয়ন সিংহ পলাশ। সেই থেকে একের পর এক শিক্ষার্থীর লাশ পড়ছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে এসে ছাত্রলীগের দুই কর্মীর দ্বন্দ্বে খুন হন অভিষেক দে দ্বীপ।
এই সময়ের মাঝের বছরগুলোতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ঘটে আরো দু’টি হত্যাকাণ্ড। ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর ছাত্রলীগ কর্মী কলেজ ছাত্র অমর আহমদ মিয়াদকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল হয়। ২০১৮ সালে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র্যালিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দলীয় কর্মী সিলেট সরকারি কলেজের ছাত্র তানিমকে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। একই বছরের অক্টোবরে তিব্বিয়া কলেজের সামনে খুন করা হয় সীমান্তিক কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র হোসাইন আল জাহিদকে। ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সহোদরকে জিম্মি করে ছাত্রলীগের সুরমা গ্রুপের কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাছুমকে খুন করা হয়।
আর গত বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে দ্বন্দ্বের বলি হলেন কলেজ ছাত্র অভিষেক দে দ্বীপ। অভিযোগ উঠেছে, বাড়ি থেকে ডেকে এনে তাকে ছুরিকাঘাত করে নিজ দলের ছাত্রলীগ কর্মী সৈকতসহ অন্যরা।
এ ঘটনার পর ফের আলোচনায় আসে টিলাগড়। নিহত দ্বীপ ও হামলাকারী সৈকত সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিত সরকার গ্রুপের কর্মী বলে জানিয়েছে পুলিশ।
খুনের ঘটনার পর সৈকতকে আটক দেখানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মহানগরের শাহপরান (র.) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে দ্বীপকে খুন করা হয়।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট রণজিত সরকার বলেন, কিছু হলেই আপনারা গ্রুপ টেনে আনেন। এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়। যে মারা গেছে, সে আমার মামাতো ভাই।
তিনি দাবি করেন, সরস্বতী পূজার সময় সৈকত ও দ্বীপের মধ্যে ঝামেলা হয়। এরই জের ধরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়ে ২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-শিবির, ২০১৩ সালের ১৯ মে ও ২০১৬ সালের ৭ মার্চ এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে দফায় দফায় অস্ত্রবাজি, নগরের কোট পয়েন্টে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সমাবেশে টিলাগড় গ্রুপের সাবেক জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপুর নেতৃত্বে হামলা-মঞ্চ ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনার পর ফের বাতিল হয় জেলা ছাত্রলীগের কমিটি।
এখনো অস্ত্রের ঝংকারে মেতে ওঠে এমসি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে টিলাগড় এলাকা। যে সাপ্লাই এলাকার কথা শুনলে নগরের মানুষের বুক ধড়ফড় করতো এখন সেই এলাকা ছাপিয়ে নগরের নতুন আতঙ্কের নাম ‘কিলিং জোন টিলাগড়’। যেখানে চুন থেকে পান খসলেই চলে রক্তের হলি খেলা।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২০
এনইউ/এজে