মানামা (বাহরাইন): ‘ভাই আমি দেশে ফেরত যেতে চাই। দালালের মাধ্যমে বাহরাইন এসে আমি প্রতারিত হয়েছি’- এভাবেই বাংলানিউজকে নিজের ভোগান্তির কথা বলছিলেন বাহরাইনে এসে প্রতারণার শিকার ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার মুন্সিগ্রামের শেখ মোহসেদের ছেলে আবদুল হালিম।
ঢাকার কেরাণীগঞ্জ ও গুলিস্তানের বঙ্গমার্কেটে শীতের জ্যাকেট, ট্রাউজার সেলাই করে ভালোই দিন কাটছিল তার। সেলাইয়ের কাজ করে মৌসুমে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করা খুবই সহজ ব্যাপার ছিল তার জন্য।
মৌসুম ছাড়াও আয় হতো মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। ছুটিতে গ্রামে গেলে পাশের বাড়ির ভিসার দালাল সোনা মিয়ার স্ত্রী তাকে বাহরাইনে অল্প পরিশ্রমে অনেক আয়ের লোভ দেখিয়ে বাহরাইনের জুস ফ্যাক্টরিতে কাজের প্রস্তাব দেয়। দৈনিক আট ঘণ্টা করে সপ্তাহে ছয় দিন কাজ, একদিন ছুটি। ভালো বেতন। আছে ওভারটাইমেরও ব্যবস্থা। গ্রামের সহজ-সরল যুবক হালিম সহজে গিলে ফেলে প্রতারকদের প্রতারণার টোপ।
সোনা মিয়ার স্ত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে সোনা মিয়ার সঙ্গে বাহরাইনে যোগাযোগ করেন হালিম। প্রতারক সোনা মিয়া তাকে এক মাসের মধ্যে বাহরাইনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। খুব দ্রুত পাসপোর্ট বানানো ও টাকা যোগাড় করার তাগিদ দেয় সে। কিন্তু হালিমের গরিব বাবা লোকজনের কাছে বাহরাইনে বাংলাদেশিদের দুরাবস্থার কথা শুনে হালিমকে সেখানে পাঠাতে রাজি ছিলেন না।
কিন্তু শেষপর্যন্ত ছেলের আগ্রহ দেখে ও দালাল সোনা মিয়ার হাল্কা কাজের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তিনি।
হালিম বলেন, আমরা আগে শুনেছি, সোনা মিয়া ভিসার দালাল। কিন্তু একদম কাছাকাছি ঘর, ভোর হলেই একে অপরের দেখাদেখি; তাছাড়া সে নিজেও বাহরাইনে আছে, এ জন্য আমাদের বিশ্বাস ছিল অন্তত আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। পাসপোর্ট বানিয়ে টাকাসহ তার স্ত্রীর কাছে দিলাম।
এরপর একমাস, দুইমাস, তিনমাস গেল। ভিসার কোনো খবর নেই। মেডিকেলের মেয়াদও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ভিসা হয় না। এভাবে পর পর দু’বার মেডিকেলের মেয়াদ শেষ হয়ে আজ হবে, কাল হবে করে আট মাস পার হয়ে গেল।
পরিবারের শেষ সম্বল আবাদি জমিটি বিক্রি করে ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ভিসার তিন লাখ টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধের পর নয় মাস পর ভিসা পাওয়া গেল।
এরপর বাহরাইনে এলে তাকে রাতে একটি জাহাজে শৌচাগারসহ জাহাজের অন্যান্য অংশ পরিস্কারের কাজ দেওয়া হয়। অনেক ঘণ্টা ডিউটি, ভারী কাজ এবং রাতভর হাড়ভাঙা খাটুনির কারণে এ কাজ থেকে ফেরত আসেন তিনি।
দালাল সোনা মিয়ার কাছে তিনি জানতে চান, তার জুস ফ্যাক্টরির কাজ কোথায়? সোনা মিয়া তাকে ধমক দিয়ে বলে- বিদেশে যখন যে কাজ মেলে, তাই করতে হয়। এসে যখন পড়েছ, কাজ তো করতেই হবে।
এ কাজ তিনি করতে পারবেন না জানালে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেয় সোনা মিয়া। হালিম দেশে ফেরত যেতে চাইলে সোনা মিয়া বলে, নিজের বিমান ভাড়া ও তার সঙ্গে কোনো লেনদেন নেই বলে সাদা কাগজে সই দিলে তাকে পাসপোর্ট দেওয়া হবে।
এরপর এলাকার লোকজন নিয়ে তার সঙ্গে কয়েকবার দেনদরবার করেও সোনা মিয়ার কাছ থেকে দেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্টটি উদ্ধার করতে পারেননি হালিম। উল্টো দেশে সোনা মিয়ার ভাইয়েরা হালিমের মা বাবাকে হুমকি দিচ্ছে, সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে বিমানভাড়া পাঠিয়ে তাদের সন্তানকে ফেরত আনার জন্য।
হালিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি দেশে ফেরত যেতে চাই। ভাই, আমাকে দেশে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেন। এই দেশে ভালো কোনো কাজ নেই!
তিনি বলেন, যে পরিশ্রমের কাজ আমাকে দিয়েছে, দেশে সেই একই পরিশ্রম করে এর চারগুণ টাকা ইনকাম করা সম্ভব।
আমার চিন্তায় আমার বৃদ্ধ বাবা-মা পাগলপ্রায়! এ বাহরাইন আমার সব কেড়ে নিয়েছে বলে অঝোরে কেঁদে ওঠেন হালিম।
বাহরাইনের অলিতে-গলিতে, পথে-প্রান্তরে কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অসংখ্য হালিম! তাদের আকুতিতে দিন দিন ভারী হয়ে উঠেছে বাহরাইনের বাতাস। কিন্তু, চার দেওয়ালে বন্দি এ সব অসহায় শ্রমিকদের আর্তনাদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায় না। যেন ধুঁকে ধুঁকে কাঁদে বিচারের বাণী!
সুবিধাভোগী সামান্য সংখ্যক প্রতারক দালালের কারণে সর্বশান্ত হচ্ছেন গরিব-অসহায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু হীন-জঘন্য এ কাজ করেও তারা থেকে যাচ্ছেন নাগালের বাইরে। প্রতারণার শিকার শ্রমিকদের প্রশ্ন, দালালরা কি এতটাই ক্ষমতাশালী যে, বছরের পর বছর তারা মরণ কামড় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, তাদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না?
কোনো রকম কারিগরি প্রশিক্ষণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভিসা ও কাজের ব্যাপারে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করে বাহরাইনে আসার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকেরা চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। সুখ-স্বপ্ন সব কিছুই থেকে যাচ্ছে অধরাই!
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৪