ঢাকা: অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার ৭ নভেম্বর নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি করছে বিএনপি। এই অতিমাত্রায় ৭ নভেম্বর প্রীতি দলটির পশ্চাদমুখী রাজনীতি পুনরায় সামনে নিয়ে আসছে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, একটা জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের পথে কোনো কোনো দিনক্ষণের ঘটনা তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য, মর্মার্থের ব্যাপকতা ও গভীরতার কারণে অন্যসব ঘটনাকে ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে অনন্য। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় 'রেড লেটার ডে' বা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত দিন হিসেবে।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস- এ দিনগুলো বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য 'রেড লেটার ডে' বা স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন।
কিন্ত ৭ নভেম্বরকে বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ‘রেড লেটার ডে’ বা স্বর্ণাক্ষরে লেখা দিন হিসেবে গ্রহণ করেনি।
কারণ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতিসত্ত্বার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল স্তম্ভ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলের ভেতরে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, যারা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের ওপর বাংলাদেশকে ধরে রাখতে পারতেন।
অতঃপর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কয়েকজন উশৃঙ্খল মেজরের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য এবং সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডকে ফিরিয়ে আনার জন্য তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সম্পূর্ণ রক্তপাতহীন একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। গৃহবন্দি হন চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জিয়াউর রহমান।
ঘটনা পরম্পরায় ৭ নভেম্বর রাত আনুমানিক ২টার দিকে জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে আসেন তিনি। সবাই তার নির্দেশ অনুসরণ করতে শুরু করেন। জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পর খালেদ মোশাররফসহ তিনজন বীর উত্তম খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। জিয়াউর রহমান কেন তাদের জীবন রক্ষা করলেন না সে রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।
এ কারণেই মানুষের ধারণা, জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার পরপরই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কব্জায় পড়ে যান। আর সে কারণেই হয়তো একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের যমদূত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ, হুদা এবং হায়দারের আর স্বাধীন বাংলাদেশে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়নি।
অধিকন্তু ৭ নভেম্বর সকালে ঢাকার রাস্তায় সৈনিকের সঙ্গে ট্রাকভর্তি বেসামরিক লোকজন স্লোগান দেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই বেসামরিক লোকজনের সবাই ছিলেন জামায়াত-মুসলিম লীগের কর্মী-সমর্থক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ৭ নভেম্বরের কারণেই বাহাত্তরের সংবিধানের প্রায় ৪০ জায়গায় জিয়াউর রহমান সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধনী আনেন। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত অনুচ্ছেদ, শব্দ ও বাক্যগুলো সংবিধান থেকে ঝরে যায়।
একাত্তরে পাকিস্তানের সহযোগী শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী হন। মন্ত্রী হন রাজাকার আবদুল আলিম এবং মাওলানা মান্নান। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অতুলনীয় গৌরব ঢেকে রাখার হীন উদ্দেশ্যে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ বিজয় দিবসের পরিবর্তে ২৬ মার্চ করা হয়।
জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না এই মর্মে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে বিধান সংযোজিত হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বাংলাদেশ মিশনে চাকরি এবং পদোন্নতি পান।
জামায়াতের ওপর থেকে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাদের আটক করা হয়েছিল, সাজা দেওয়া হয়েছিল তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে গোলাম আযম বাংলাদেশে আসার সুযোগ পান।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মঈন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে আসে এবং পাকিস্তান দূতাবাসের গাড়িতে করে পুলিশ প্রহরায় তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
৭ নভেম্বরের পর সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রায় ২১টি ক্যু সংঘটিত হয়। এই ক্যুর সূত্র ধরে প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের ফাঁসি হয় অথবা বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতিহাসের কালিমালিপ্ত এই ৭ নভেম্বর নিয়ে বিএনপি যেসব নেতা অতিমাত্রায় মাতামাতি করছেন, তারা আদৌ বিএনপি শুভাকাঙ্ক্ষি, নাকি কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন?
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির প্রবীণ ও পোর খাওয়া নেতারা এই মাতামাতির মধ্যে নেই। বরং হালে বিএনপির ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হওয়া দুই তিনজন নেতা বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা করেছেন। লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ করার অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে সরকারকে চেতিয়ে তুলেছেন। অথচ বিগত বছরগুলোতে সেমিনারেই সীমাবদ্ধ ছিল বিএনপির ৭ নভেম্বর!
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৬
এজেড/জেডএস