ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাজেট

ঘাটতি বাজেট সময়ের বাস্তবতা, বিদেশি ঋণেই মেটানো দরকার

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৮ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০২২
ঘাটতি বাজেট সময়ের বাস্তবতা, বিদেশি ঋণেই মেটানো দরকার

ঢাকা: প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিশাল বাজেটে ঘাটতির অঙ্কও বড় করা হয়েছে। তবে বাজেটের আকার ও ব্যয় বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না আয়।

ফলে বড় হচ্ছে ঘাটতির অঙ্ক আর সেজন্যই বাড়ছে ঋণ নির্ভরতা। প্রস্তাবিত নতুন অর্থবছরের জন্য বড় ঘাটতি রেখে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবায়নে নির্ভর করতে হবে বড় অঙ্কের ঋণের ওপর। আর এ ঋণের প্রায় অর্ধেক নেওয়া হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এবারই প্রথম ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। সঞ্চয়পত্র থেকেও ধারের অঙ্ক কিছুটা বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থনীতিবিদরা ঘাটতি বাজেটই এখন অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে পারে এবং ঘাটতি বাজেটকে ‘সময়ের বাস্তবতা’ বলে উল্লেখ করেছেন তারা। তবে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বেসরকারিখাতে যেন ঋণ প্রাপ্তিতে সমস্যা না হয়। ফলে আমরা মনে করি বৈদেশিক ঋণ দিয়েই বেশি ঘাটতি মেটানো দরকার।

বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে ব্যাংক থেকেই ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ধার করার পরিকল্পনা রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানাবিধ অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে জোগান দেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ঘাটতির এ পরিমাণ আগের যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে এ ঘাটতি পূরণ করতে হবে। আর সেজন্য নতুন বাজেটে বিদেশি ঋণের নির্ভরতা অনেকটাই বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এবার বিদেশ থেকে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা আসবে বলে আশা করছেন তিনি। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের ঘাটতি বাজেট ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে করোনার কারণে গত দুই (২০২০-২১ ও ২০২১-২২) অর্থবছরে সেটি ৬ দশমিক ২ শতাংশের সীমাও ছাড়িয়ে যায়। সেটিকেও অর্থনীতিবিদরা সময়ের বাস্তবতা বলে মনে করেছেন।

এবার দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধক উদ্দীপক কর্মসূচি নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই ঘাটতি বাজেটের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়েছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের বিভিন্ন অংশের আলোচনায়। অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি মেটাতে চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে তিনি তা সমন্বয় করতে সক্ষম হবেন।

বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এ বছর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান পরিশোধ করতে হয় না। এজন্য এটি সরকারের আয় মনে করা হয়।

এ ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ৯৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও অর্তনীতিবিদ অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ৫.৫ শতাংশ ঘাটতি তেমন বড় কিছু না। তবে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে অনেক ঋণ নিতে হবে সরকারকে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বেসরকারিখাতে যেন ঋণ প্রাপ্তিতে সমস্যা না হয়। কারণ এখন এমন একটা সময় সঞ্চয়ের প্রবণতার ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতির কারণে। প্রকৃত সঞ্চয়ের হারতো নেগেটিভ হয়ে গেছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ব্যাংকের তারল্যের সমস্যা হতে পারে। সেখানে সরকার একক ঋণ নিলে ব্যক্তিখাতেও ঋণের সমস্যা হবে। এ সমস্ত বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন আছে। আমরা মনে করি বৈদেশিক ঋণ দিয়েই বেশি ঘাটতি মেটানো দরকার।

এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঘাটতি বেশি হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না আমি। এখন আমাদের বেশি বেশি খরচ করতে হবে। তবে বৈশ্বিক অস্থির পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় যতটা সম্ভব বিদেশি ঋণ কম নিয়ে বিদেশি অনুদান আনার চেষ্টা বেশি করতে হবে। একইসঙ্গে বাজেটের টাকা সঠিকভাবে ব্যয় করতে হবে সামাজিক সুরক্ষামূলক বিভিন্ন খাতে। বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে উৎপাদন বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জরুরি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অবকাঠামো খাতে। এর ফলে মানুষের সক্ষমতা বাড়বে ও নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

একইভাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান মনে করেন, ঘাটতি বাজেট শুধু দায় সৃষ্টি করে না, ঘাটতি দিয়ে যদি সক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং অবকাঠামো খাতে ব্যয় করা হয়, তাহলে আয়ও সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৩৭ ঘণ্টা, ০৯, ২০২২ 
জিসিজি/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।