ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

পৌরবর্জ্য যেন ‘গলার কাঁটা’, দূষণের কবলে পরিবেশ

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৩ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০২৪
পৌরবর্জ্য যেন ‘গলার কাঁটা’, দূষণের কবলে পরিবেশ

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ড থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে পৌর কর্তৃপক্ষ। প্রথমে সংগ্রহ করা বর্জ্য সড়কের পাশে বা জনবহুল এলাকায় ফেলা হয়।

এরপর জমানো বর্জ্য সেখান থেকে নেওয়া হয় স্যানিটারি ল্যান্ডফিল এলাকায়। কিন্তু সেই ল্যান্ডফিলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না৷ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তিন বছর আগে স্যানিটারি ল্যান্ডফিল নির্মাণ করলেও তা এখনো কোনো কাজে আসেনি।  

পৌরবাসীর এ বর্জ্য এখন যেন ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগ্রহ করা বর্জ্যের স্তূপের দিন দিন বড় হচ্ছে, আর সে বর্জ্য আগুনে পুড়িয়ে কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করে পরিবেশ দূষণ করা হচ্ছে। আবার বর্জ্য দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে পুকুর বা নিচু জমি। ল্যান্ডফিলের আশপাশে স্তূপ করা বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। পলিথিন বা প্লাস্টিক আগুনে পোড়ানোর কারণে সৃষ্ট ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে বায়ুমণ্ডলে।  আগুনে পুড়িয়ে এবং পুকুর ভরাট করেও কমানো যাচ্ছে না বর্জ্যের পরিমাণ। বর্জ্য ফেলার পরিমাণমতো জায়গাও নেই। তাই ফেলা হচ্ছে ল্যান্ডফিলের আশপাশের ফসলি জমিতে।

জমির মালিকদের অভিযোগ, পৌর কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক তাদের কৃষি জমি দখল করে বর্জ্য ফেলছে। আবার ল্যান্ডফিল সংলগ্ন বাসিন্দাদের অভিযোগ, বর্জ্যের দুর্গন্ধে বসবাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।  

সূত্র জানায়, ১৯৭৬ সালে ২৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত হয় লক্ষ্মীপুর পৌরসভা। বর্তমানে প্রথম শ্রেণির পৌরসভা এটি। লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের এ পৌরসভার প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস। কিন্তু পৌরসভা গঠনের ৪৮ বছর পরেও এখানে একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে পৌরসভা ও জেলা শহরটির ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে।

২০২১ সালে পৌর এলাকার লক্ষ্মীপুর-মজুচৌধুরীর হাট সড়কের পাশে যুব উন্নয়ন ভবনের পেছনে একটি স্যানিটারি ল্যান্ডফিল স্থাপন করা হয়। তৃতীয় নগর পরিচালন ও অবকাঠামো উন্নতিকরণ (সেক্টর) প্রকল্প স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি বাস্তবায়ন করে এলজিইডি, ডিপিএইচই ও লক্ষ্মীপুর পৌরসভা। প্রায় ছয় কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটির যৌথ অর্থায়ন করে বাংলাদেশ সরকার, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও ওপিইসি ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে সংগ্রহকৃত বর্জ্য থেকে পচনশীল এবং অপচনশীল বর্জ্য পৃথকীকরণ করে কাজে লাগানোর কথা ছিল। পচনশীল বর্জ্য দিয়ে জৈব সার এবং অপচনশীল (পলিথিন, প্লাস্টিক) বর্জ্য দিয়ে তেল উৎপাদন করা বা উৎপাদনকৃত কারখানায় সরবরাহ করার কথা। এছাড়া সংগ্রহকৃত মানববর্জ্যও প্রক্রিয়াজাত করে সার তৈরির জন্য ল্যান্ডফিল পাম্প হাউজ তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা দেয় দাতা সংস্থা। কিন্তু সরকার ও দাতা সংস্থার দেওয়া নির্দেশিত শর্ত পালন করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ।

নির্মাণ সহায়তাকারী কর্তৃপক্ষের শর্ত ছিল, কারিগরি ও আর্থিকভাবে সহায়তা পেতে ল্যান্ডফিল স্টেশন নির্মাণের আগে ওই এলাকায় যেসব বর্জ্য ফেলা হয়েছিল, পৌর কর্তৃপক্ষ তা স্বল্প সময়ের মধ্যে অপসারণ করবে। কিন্তু সে শর্ত পূরণ করতে পারেনি পৌরসভা। পৌর এলাকা থেকে সংগ্রহকৃত বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা এবং আগুনে পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণের কারণে প্রকল্প ‘থমকে’ গেছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও জনবল এবং অর্থের দোহাই দিয়ে তা বন্ধ রেখেছে পৌর কর্তৃপক্ষ। ফলে গত তিন বছর ধরে অলস পড়ে আছে ল্যান্ডফিলটি। এমতাবস্থায় পৌরবাসী ও পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের বর্জ্য নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্প থেকে জনবল এবং অর্থ না দেওয়ার কারণে ল্যান্ডফিলটি চালু করা যাচ্ছে না।  আবার পৌরবাসীর অভিযোগ, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করায় যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে পৌরসভা।

জেলা শহরের উত্তর তেমুহনী এলাকায় একটি ভবনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে লক্ষ্মীপুর পৌরসভা কার্যালয় অবস্থিত। কিন্তু পৌর কার্যালয়ের সামনেই সড়কের পাশেই সিএনজি স্টেশনের পাশেই প্রতিদিন বর্জ্য ফেলা হয়। জনবহুল এই এলাকায় বর্জ্য রাখার কারণে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এছাড়া লক্ষ্মীপুর-রায়পুর মহাসড়কের পাশে ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন এলাকায় ময়লা-আবর্জনা ফেলছে পৌর কর্তৃপক্ষ। আর ল্যান্ডফিলের আশপাশের ফেলা বর্জ্যের স্তূপ দিনের পর দিন বড়ই হচ্ছে। সব ধরনের আবর্জনা ফেলা হচ্ছে সেখানে।  

ল্যান্ডফিলের পাশে থাকা একজন জমির মালিক মো. ইমতিয়াজ হোসেন। সেখানে ৭৭ শতাংশ জমি রয়েছে তার। কৃষি আবাদ হত ওই জমিতে।

বাংলানিউজের কাছে ইমতিয়াজ অভিযোগ করেন, পৌর কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক তার কৃষি জমিতে বর্জ্য ফেলা শুরু করে। তিনি বাধা দেওয়ায় হুমকির মধ্যে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে আদালতে ১৪৪ ধারার মামলা করলেও সেটা উপেক্ষা করে গত দুই বছরে তার পুরো জমিতে বর্জ্যের স্তূপ দেওয়া হয়েছে। তার মতো আরও বেশ কয়েকজনের জমিতে জোরপূর্বক বর্জ্য ফেলা হয়। বর্জ্যের কারণে ল্যান্ডফিল সংলগ্ন বাসিন্দাদের বসবাস হুমকির মুখে।

স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কথা জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা মো. আলম বাংলানিউজকে বলেন, ল্যান্ডফিলের মুখেই আমাদের বসতি। দুটি ঘরে আমরা ১১ জন লোক থাকি। আমাদের শিশুরাও রয়েছে। বর্জ্যের দুর্গন্ধে আমরা টিকতে পারি না। আবর্জনায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ধোঁয়ায় শিশুদের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। বর্জ্য ‘গলার কাঁটা’ হওয়ায় ওই বর্জ্য দিয়ে পুকুর ভরাট করেছে পৌরসভা।

সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর-রায়পুর মহাসড়কের ইটের পুল এলাকার দক্ষিণ দারগাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে থাকা পুকুর বর্জ্য দিয়ে ভরাট করা হয়। বর্জ্য না ফেলতে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান আন্দোলন করেছে। স্থানীয় লোকজন এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাধা উপেক্ষা করে পরিবেশ দূষণ করে সেখানে বর্জ্য ফেলা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সাইফুল ইসলাম শরীফ বলেন, আবর্জনার দুর্গন্ধে শ্বাসনালিতে ইনফেকশন হয়ে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কনজারভেশন ইন্সপেক্টর পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফয়েজ আহম্মদ জানান, দীর্ঘ সময় ময়লা ফেলার সুনির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। পৌরসভার ময়লা দিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি খালি জায়গা পূরণ করা হত। ২০২১ সালে পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডে সরকারি ও দাতা সংস্থার অর্থায়নে চার একর জমির ওপর ল্যান্ডফিল তৈরি করা হয়। এখানে মানববর্জ্য ও গৃহস্থালির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পৃথক ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। তবে ডাম্পিং স্টেশনটিতে অপচনশীল বর্জ্য ‘রিসাইকেল’ ইউনিট নেই।

তিনি জানান, নির্মাণের পর অপচনশীল বর্জ্য বাছাইয়ের জন্য দৈনিক ভিত্তিতে ডাম্পিং এলাকায় ১৬ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। আর্থিক সুবিধা বন্ধ হওয়ায় পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য বাছাইয়ের তারা এখন আর কাজ করছেন না।

তিনি আরও জানান, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে ৩০ টন বর্জ্য সংগ্রহ হয়। এর ৪০ শতাংশই অপচনশীল বর্জ্য। প্রতিদিন পাঁচটি ছোট ট্রাক, ৩৫টি ভ্যানগাড়ির মাধ্যমে ৮২ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসব বর্জ্য সংগ্রহ করেন।

লক্ষ্মীপুর শহরের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন এবং সুমন দাস জানান, পৌরসভা বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে মাসিক ১শ টাকার বিনিময়ে বর্জ্য নিয়ে শহরের এখানে সেখানে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।

পৌর শহরের আরেকজন বাসিন্দা মীর ফরহাদ সুমন বলেন, দ্রুত স্যানিটারি ল্যান্ডফিলটি চালু করে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শহরের পরিবেশ টিকিয়ে রাখা হোক।  

লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভুঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, জনবল সংকট ও অর্থ সংকটের কারণে ল্যান্ডফিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বন্ধ রয়েছে। প্রকল্প থেকে আর্থিক সহায়তা করা হলে সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যাবে।

পৌরমেয়র আরও বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অন্য আরেকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে বর্জ্য থেকে জৈব সার ও জ্বালানি তেল উৎপাদন করা যায়। চলতি বছরেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদী তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০২৪
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।