ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৪ পৌষ ১৪৩১, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

সিডরের ১৭ বছর

চাচারে খুঁজতে যাইয়া দেহি সাগরে লাশ আর লাশ!

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৪
চাচারে খুঁজতে যাইয়া দেহি সাগরে লাশ আর লাশ!

পাথরঘাটা (বরগুনা): ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, উপকূল দিয়ে বয়ে যায় ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডর। সিডরের ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি পাথরঘাটার উপকূলবাসী।

প্রতি মুহূর্ত পাথরঘাটার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বাসিন্দাদের কাঁদায়। সিডরে কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ হারিয়েছেন স্বামী আবার কেউ হারিয়েছেন সন্তান। স্বজনদের অপেক্ষা যেন আজও শেষ হয়নি।

সিডরের দীর্ঘ ১৭ বছর পেরিয়েছে আজ। পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী ৩৪৯ জনের প্রাণহানি হয়। আর সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ কয়েকশ জেলে, যাদের খোঁজ আজও মেলেনি। ক্ষতি হয় গাছ-পালা, ঘরবাড়িসহ সম্পদ, হাজার হাজার গবাদিপশু। অপরিমেয় ক্ষতি হয় পাথরঘাটার ফসল ও ধ্বংস হয় উপকূলীয় অঞ্চলের বনাঞ্চল। সিডরের ক্ষত আজও দেখা মেলে বলেশ্বর নদ সংলগ্ন পদ্মার বেড়িবাঁধ এলাকায়। সিডরের পর পদ্মা ভাঙন হিসেবেই পরিচিত। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। যেকোনো ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের যে কয়েকটি এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম উপকূলীয় এলাকা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর দেখিয়ে দিয়েছে তার তাণ্ডবলীলা।

কথা হয় সিডরে সাগরে মাছ ধরার সময় নিখোঁজ পাথরঘাটা উপজেলার সদর পাথরঘাটা ইউনিয়নের বাদুরতলা গ্রামের বাবু ফকিরের মা ছালেহা বেগমের সঙ্গে। সিডরে একমাত্র ছেলে মো. বাবু ফকিরকে হারিয়ে প্রতি মুহূর্ত ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদেন ছালেহা। ছেলের উপার্জনেই নির্ভর ছিলেন ছালেহা-আজিজ ফকিরের সংসার। জীবিকার তাগিদে সাগরে যাওয়ার পর বাবু আর ফিরে আসেননি। আজও একমাত্র ছেলেকে ভুলতে পারেননি মা ছালেহা।

কথা হয় ছালেহা বেগমের সঙ্গে। সিডরের আগে বাবু ফকিরের সাগরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। স্বামীর অসুস্থতার কারণে ছেলের কথা মনে পড়লেই আলাদা জায়গায় গিয়ে কান্না করেন। কখনো কখনো নামাজের ঘরেও কান্না করেন। আজও ছেলের পথের দিকে তাকিয়ে আছেন ছালেহা।

তিনি বলেন, বাবু সাগরে যাওয়ার সময় একটি বড় পোমা (পোয়া) মাছ দিয়া গেছে খাওয়ার জন্য। আরও বলে গেছে, ‘এবার সাগর থেকে আসার সময় বড় ইলিশ মাছ নিয়া আইবে। ’ কিন্তু ইলিশ মাছ দিয়া কি করমু, মোর পোলাডাইতো আয়নায়। বিয়া করার ১০ মাস পর সাগরে যাইয়া পোলায় আর আয়নায়। ছালেহা বলেন, একমাত্র পোলার কামাইয়ে সংসার চলতে। অসুস্থ স্বামী বিছানায়, কাজ করতে পারছে না। আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করি আর বনের মধ্যে খালে মাছ ধরি, তা বিক্রি করে যা পাই তা দিয়া সংসার চালাই। আমার পোলা হয়ত আর বেঁচে নেই। মন তো মানে না। আজও আমরা বুড়াবুড়ি সন্তানের আসার পথের দিকে তাকিয়ে আছি। কেউ খোঁজ নেয় না।

প্রলয়ংকরী সেই ঘূর্ণিঝড়ে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার উপকূলে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়। একই পরিণতি হয় সেই সময় সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া অসংখ্য জেলের। অনেকে ভাগ্যক্রমে ফিরে এলেও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে। আজও তাদের সন্ধান মেলেনি। শুধু বাবু ফকিরই নয়, তাদের গ্রামের প্রায় পরিবার থেকেই সিডরে নিখোঁজ হয়। বাবুর সঙ্গে একই ট্রলারে থাকা জাকির হাওলাদার, ইসমাইল হোসেন, হারেজ বিডিয়ারসহ একই এলাকার নয়জন আজও ফেরেনি।

কথা হয় সিডরে সাগরে নিখোঁজ হারেচ মৃধার ছেলে আফজাল মৃধার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাবা আজও আসেনি। বাবায় বিডিআর (বিজিবি) থেকে অবসরের পর ট্রলার তৈরি করে সাগরে প্রথম যায়। এই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া, প্রথম গিয়েই শেষ বিদায় নিলো। আজ বাবা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন খোঁজ নেই।

অপরদিকে কথা হয় হারেচ মৃধার ভাইয়ের ছেলে মো. ফারুক মৃধা, তিনি বলেন, সিডরের পর যখন চাচা ফিরে আসেনি তখন কয়েকজন মিলে সাগরে খুঁজতে যাই। সুন্দরবন সংলগ্ন নারিকেলবাড়িয়া, বান্দার বাড়িয়াসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজাখুঁজি করি কিন্তু চাচারে আর পাইলাম না, কিন্তু পাইলাম অনেক লাশ। ওই লাশের মধ্যে চাচারে দেখলাম না। একই জায়গায় ৭২টি লাশ বালুর নিচে চাপা দেওয়া দেখেছি।

উপকূল অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, সিডরের তাণ্ডবের চিত্র আজও ভোলেনি এ অঞ্চলের মানুষ। প্রতিনিয়তই উপকূলবাসীকে কাঁদায়, আজও নিখোঁজদের পথপানে চেয়ে আছে এখানকার পরিবারের সদস্যরা। আমরা সিডরে নিহত এবং ১৯৯৩ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে ১৮৮ জন জেলে নিখোঁজদের স্মরণে স্মৃতি ফলক স্থাপন করেছি, যা দেশে এই প্রথম।

তিনি আরও বলেন, পাথরঘাটায় একটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। পাথরঘাটাবাসীদের কাছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস নিত্যদিনের সঙ্গী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমশ নানা দুর্যোগ বাড়ছে। এজন্য উপকূল নিয়ে সরকারের ভাবতে হবে, নতুন নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে। টেকসই উপকূল, উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা, পুনর্বাসন করতে উপকূল মন্ত্রণালয় এবং উপকূল উন্নয়ন বোর্ড আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।

পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, সিডরে পাথরঘাটায় উপজেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী ৩শ ৪৯ জন মারা গেছেন, নিখোঁজ রয়েছেন কয়েকশ জেলে। সিডরে নিহতের স্মরণে উপজেলা পরিষদের মুক্তমঞ্চে তালিকা সম্মলিত স্মৃতি ফলক করা হয়েছে। যা বাংলাদেশে এই প্রথম। ইতোমধ্যেই আমরা ৩৪৯ পরিবারের মাঝে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া শুরু করে দিয়েছি। তাদের জন্য আলাদা কি করা যায় তা ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০২৪
এএটি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।