শ্রীমঙ্গল: একসময় ওরা আমাদের পাশের বনেই ছিলো। কিন্তু আজ নেই।
'বন্যপ্রাণি শিকার ও পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি' –এ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণি দিবস। বিশ্বে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে দিবসটি।
২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রথম উদযাপিত হয় ২০১৪ সালে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গতবছরের মতো এবারও পালন করছে দিবসটি।
বিশ্ব জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে আমাদের দেশে। সে হিসেবে আমাদের দেশে এই দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর মধ্যে পৃথিবীর ৫৬০তম।
আমাদের ষোলটি জাতীয় উদ্যান রয়েছে। এগুলো হলো- লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, মধুপুর জাতীয় উদ্যান, রামসাগর জাতীয় উদ্যান, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান, মেধা কচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান, বাড়ৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান, নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান, সিংড়া জাতীয় উদ্যান, কাদিগড় জাতীয় উদ্যান, এবং আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান।
আর সতেরটি বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্যগুলো হলো- রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য, চর কুকরি-মুকরি অভয়ারণ্য, সুন্দরবন (পূর্ব) অভয়ারণ্য, সুন্দরবন (পশ্চিম) অভয়ারণ্য, সুন্দরবন (দক্ষিণ) অভয়ারণ্য, পাবলাখালী অভয়ারণ্য, চুনাতি অভয়ারণ্য, ফাসিয়াখালি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য, দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য, হাজারিখিল বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য, সাঙ্গু অভয়ারণ্য, টেকনাফ গেম রিজার্ভ, টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, দুধমুখী অভয়ারণ্য, চাঁদপাই অভয়ারণ্য, ঢাংমারী অভয়ারণ্য এবং সোনারচর অভয়ারণ্য।
এসব জাতীয় উদ্যান আর বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য নিয়েই আমাদের মূল্যবান বন্যপ্রাণি সম্পদ। কিন্তু যে হারে সেসব সংরক্ষিত বনের প্রাচীন ও দীর্ঘতম গাছপালা কেটে, গোপনে নানা প্রজাতির প্রাণী শিকার করে কিংবা প্রাকৃতিক চিরসবুজ বনকে নানাভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে মূল্যবান জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে বাধ্য। এখনো যতটুকু বনভূমি বা জীববৈচিত্র্য অবশিষ্ট রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি বিষয়ে অনেক সফলতার প্রমাণ পাবে।
ইকোসিস্টেমের পরিবর্তনের কারণে সমতল ভূমির বন্যপ্রাণি অবলুপ্তির পথে। মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশের হঠাৎ কোনো পরিবর্তন, অবাধে চিরসবুজ বন ও গাছপালা ধ্বংস, বনে অবৈধ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে অতিমাত্রায় শিকার, প্রাণীদের খাদ্যাভাব, বিষাক্ত কীটনাশকের প্রভাবে মৃত কীট-পতঙ্গ খেয়ে মারা যায় অথবা প্রজননের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা, বিদেশি প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের ফলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব, দীর্ঘস্থায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবসহ নানা কারণে একটি দেশ থেকে বন্যপ্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে। তবে কোন বন্যপ্রাণি প্রজাতি বিলুপ্তির ক্ষেত্রে মানুষের সৃষ্ট কারণই কার্যকর বেশি।
গভীর আক্ষেপ নিয়ে বলতে হয় অর্ধ-শতাব্দীকাল বা শতাব্দীকাল আগেও যে প্রাণীগুলো আমাদের দেশের বনাঞ্চলে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতো তারা আজ হারিয়ে গেছে চিরতরে। বন্যপ্রাণি নিয়ে গবেষণা-সংরক্ষণ আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে অনেকটাই ক্ষীণ। তবুও কেউ কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যাগে তা করে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে আমাদের অনেক উপকার করে চলেছেন।
প্রখ্যাত বন্যপ্রাণি গবেষক ড. রেজা খানের মতে (১৯৮৩), বাংলাদেশে ৮৪০টি প্রজাতির বন্যপ্রাণি রয়েছে। যাতে ১৯টি প্রজাতির উভচর, ১২৪টি সরীসৃপ, ৫৭৮টি পাখি, ১১৯টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী। এছাড়াও ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত প্রফেসর সোহরাব উদ্দিন সরকার ও প্রফেসর নূরজাহান সরকার তাদের একটি গ্রন্থে ৯৩২টি প্রজাতির বন্যপ্রাণির কথা উল্লেখ করেন। যাতে ২৩টি প্রজাতির উভচর, ১৫৪টি সরীসৃপ, ৬৩২টি পাখি, ১২৩টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন, বাংলাদেশ) এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ৮৮৯টি প্রজাতির বন্যপ্রাণি রয়েছে যাতে ২২ প্রজাতির উভচর, ১২৬ সরীসৃপ, ৬২৮টি পাখি, ১১৩টি স্তন্যপায়ী। তাদের মতে, ৬২৮ প্রজাতির পাখির ২৪০ প্রজাতি পরিযায়ী পাখি, ৪২৮টি প্রজাতি আবাসিক পাখি।
২০০০ সালে আইইউসিএন বাংলাদেশ এর তথ্যানুযায়ী এই বিলুপ্ত বন্যপ্রাণির সংখ্যা ১৩টি। এর মধ্যে একটি সরীসৃপ, দু’টি পাখি, ও দশটি স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে। এগুলো হলো- ১. সরীসৃপ: মিঠা পানির কুমির (বৈজ্ঞানিক নাম Crocodylus Palustris), ২. পাখি: ময়ূর (বৈজ্ঞানিক নাম Pavo Cristatatus), ৩. গোলাপিমাথা পাতিহাঁস (বৈজ্ঞানিক নাম Rhodonessa Curyophyllacea), ৪. স্তন্যপায়ী: নেকড়ে (বৈজ্ঞানিক নাম Canis Lupus), ৫. শূকর হরিণ (বৈজ্ঞানিক নাম Axis borcinus), ৬. জলার হরিণ (বৈজ্ঞানিক নাম Cervus davauceli) ৭. নীলগাই (বৈজ্ঞানিক নাম Boselaphus tragcamelus), ৮. বন্যমহিষ (বৈজ্ঞানিক নাম Bubalus bubalus), ৯. বান্টেং (বৈজ্ঞানিক নাম Bos banteg), ১০. গাউর (বৈজ্ঞানিক নাম Bos gaurus),
১১. দ্বিশৃঙ্গী গন্ডার (বৈজ্ঞানিক নাম Didermoceros sumatrensis), ১২. জাভা গন্ডার (বৈজ্ঞানিক নাম Rhinoceros sondaicus), ১৩. একশূঙ্গী গন্ডার (বৈজ্ঞানিক নাম Rhinoceros unicornis)।
বন্যপ্রাণি গবেষক ও অধ্যাপক গাজী আসমত তার বাংলাদেশে বিলুপ্ত বন্যপ্রাণি বইয়ে ২২টি বিলুপ্ত বন্যপ্রাণির কথা উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৫