শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): এক সময় শেষ হয় পনেরো-ষোলো দিনের ডিমে তা দেওয়ার পালা। বাঁলিহাস দম্পতি এই দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে পালন করে ডিম থেকে প্রকৃতিকভাবে সৃষ্টি করছে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম।
জন্মের পরপরই প্রকৃতিগতভাবে তারা বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ছানা ডিম থেকে বের হয়েই ওই কৃত্রিম কাঠের বাক্সের ত্রিশ সেন্টিমিটার উপরের ফুটো দিয়ে লাফিয়ে বিলের পানিতে গিয়ে পড়ে।
কোনো কোনো ছানা আবার ফুটোর বিষয়টি শুরুতেই ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারে না। খুঁজে পায় না বাক্সের ওই ফুটো। ছটফট করতে করতে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একসময় ঠিকই ছানাগুলো ওই বিশেষ ফুটোটি আবিষ্কার করে ফেলে।
লাফ দিয়ে তারা পড়ে যায় বিলে। মনের আনন্দে তারা ভেসে বেড়াতে থাকে বিলের জলে। একই সঙ্গে চলে প্রকৃতি থেকে ওদের খাবার সংগ্রহের কাজটিও।
বাইক্কা বিলের সংরক্ষিত মৎস্য অভয়াশ্রম এলাকায় পাখিদের প্রজননের জন্যে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি বাক্সগুলো পুরোপুরি সফল। বাক্সগুলো যথাযথভাবে তৈরি না হলে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো। এমনকি ছানাগুলোও মরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতো।
বিলুপ্তপ্রায় বাঁলিহাসের প্রজনন রক্ষার এ উদ্যোগ সম্পর্কে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক।
তিনি বলেন, বাইক্কা বিলের কাঠের বাক্সে বাঁলিহাসের প্রজনন রক্ষার বিষয়টি আমি অসাধারণ একটি সাফল্য হিসেবে দেখছি। সিডাব্লিউবিএমপি প্রজেক্টের উদ্যোগে আমরা হাকালুকি হাওরেও এমন পদ্ধতি ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু সেটি থেকে সফলতা আসেনি। বাইক্কা বিলে আমাদের এ উদ্যোগটিই সফলতার মুখ দেখেছে। এ বিষয়ে আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন নিবেদিতপ্রাণ পাখি বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের উপদেষ্টা পল থমসন।
যে পাখি বা হাঁস গর্তে বাসা করে তাদের জন্য বাক্স সহায়ক হতে পারে। কিন্তু বাক্সের মাপ যদি সঠিক না হয় তবে সব ছানাগুলো মরে যাবে। বাঁলিহাসের ছানা ফোটার পর সে লাফ দেয়। লাফ দিয়ে গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে হেঁটে হেঁটে বিলে নামে অথবা সরাসরি বিলের পানিতে গিয়ে পড়ে। এখন যদি বাক্সর গর্তটি যথাস্থানে না হয় তাহলে বাচ্চা বেরুতে পারবে না। বেরুতে না পারলে অবশেষে মরে যাবে। আবার যদি বাক্সের তলার বেশি কাছে গর্ত হয় তবে ছানাগুলোকে দেখে অন্য শিকারি পাখি এসে খেয়ে ফেলবে।
সুতরাং, যেনতেনভাবে কাঠের বাক্স তৈরি করে দিলেই হবে না। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে থাকলাম। পরবর্তীতে আমরা আমেরিকান উড ডাক (American Wood Duck) এর জন্য ব্যবহৃত কাঠের বাক্সের আদলে বাঁলিহাসের জন্য অনুরূপ বাসা তৈরি করে ২০০৬ সালে বাইক্কা বিলে স্থাপন করলাম। দু-তিন বছর পর ধীরে ধীরে এটি সফল হতে থাকলো।
বালিহাঁসের বাচ্চাগুলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে পড়ে যাবে পানিতে। পানিতে পড়েই ওরা নিজের খাবার নিজে খাবে। লুকাবে। ওরা জলজ উদ্ভিদগুলোই খায় এবং ওর ভেরতরেই লুকায়। হাওর-বিলে বেঁচে থাকে। ওরা চিল, বাজ প্রভৃতি শত্রু এলে যখনই ওদের মায়েরা সংকেত দেবে তখনই তারা লুকিয়ে যাবে এবং কিছুক্ষণ পর দূরে গিয়ে আবার উঠবে। ভেসে বেড়াবে। তখন ধরতে গেলেও তাদের ধরা যায় না। প্রথম দিন থেকেই খুবই ভালো ডুবুরি ওরা।
ইনাম আল হক বালিহাঁস প্রসঙ্গে বলেন, এটি বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসকারী হাঁস। কিন্তু এই হাঁসটি বাসা তৈরি ও ডিমপাড়ার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়। কারণ ওরা বাসা বাঁধে জলাশয়ের কাছে বড় বড় গাছের কোঠেরে। যে গাছগুলোর অভাব রয়েছে বাংলাদেশে। অথবা পানির কাছে কোনো দেউল, মঠ-মন্দির বা পরিত্যক্ত দালানের মধ্যে। এসবগুলোই এখন কমে গেছে। এগুলো যে আজ নেই তা নয়। অনেকদিন ধরেই এসবের অভাব। মূলত এগুলোর অভাবেই তাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছিলো না।
বালিহাঁসের প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে এই পাখি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এখন ওরা শুধু বড় বড় হাওরগুলোতেই থাকে। যেখানে মানুষের আনাগোনা কম। ১৫ বছর আগেও আমি ঢাকার অদূরের একটি বিলে ওদের দেখেছি। বিলটি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এখন আর নেই। ছোট ছোট জলাশয়ে মানুষের অত্যাচারে ওরা টিকতে পারে না। মানুষ ওদের মেরে ফেলে। মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, ছাতিধরা বিল প্রভৃতি জলাশয়ে এখন তাদের দেখা যায়। সিলেট বিভাগেই এখন এদের দেখতে পাই।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫
বিবিবি/এএ
** বাইক্কা বিলে ছানা ফোটাচ্ছে বিপন্নপ্রায় বালিহাঁস