বিরুলিয়া (সাভার) থেকে ফিরে: ঢাকার অদূরে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রাম। মাঠ, পুকুরপাড়, কাঁঠালবাগান ও বসতভিটার চারপাশে পাশে সবুজ গাছে অপরুপ গোলাপের গোলাপি হাসি।
গোলাপ চাষে এক ধরনের বিপ্লব ঘটেছে এখানে।
গোলাপ ফুল চাষে ভাগ্যবদল হয়েছে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবারের। পতিত কিংবা কম ফসল উৎপাদন হওয়া জমি থেকে এখন আয় হচ্ছে লাখ টাকার গোলাপ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে এখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে গোলাপ চাষে জড়িত। বাকি ২০ শতাংশ মানুষ ব্যস্ত সবজি চাষে।
বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান মিয়া(৬৫)। এক সময় অভাব অনটনের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। যে কারণে তিন ছেলে সঞ্জু মিয়া, দুলাল মিয়া ও আব্দুস সবুরকে লেখা পড়া শেখানে পারেননি বাবা শাহজাহান। এখন সবাই গোলাপ চাষের সঙ্গে জড়িত।
প্রায় ১১ বিঘা গোলাপ চাষ করে প্রতি মাসে অাড়াই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করছেন শাহজাহান মিয়া। প্রায় ২০ বছর আগে তিনি প্রথম সাদুল্লাপুরে গোলাপ চাষ শুরু করেন। এখন তার সন্তানেরা সব সময় ব্যস্ত থাকেন গোলাপের গোলাপি মাঠে।
শাহজাহান মিয়ার ছোট ছেলে আব্দুস সবুর বাংলানিউজকে বলেন, ‘১০ বিঘা জমিতে আল্লাহ দিলে প্রতিমাসে খরচ খরচা বাদ দিয়ে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লাভ থাকে। মাটির বাড়ি ছিল এখন ছাদের বাড়িও তৈরি করেছি গোলাপ বিক্রির টাকা দিয়ে’।
শুধু সাদুল্লাপুরই নয়, বিরুলিয়া ইউনিয়নের মোস্তাপাড়া, বাগ্নিবাড়ি ও শ্যামপুর গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েও চেখে পড়ে চোখ জোড়ানো গোলাপের বাগান। বাগানের চারদিকে তাকালে সবার মন ভরে যায় বলেও দেখতে আসেন অনেকেই। যে কারণে গোলাপচাষিরা অনেক সময় দর্শনার্থীদের বিড়ম্বনায় পড়েন।
মোস্তাপাড়া গ্রামের গোলাপচাষি সাইফুল মোড়ল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আল্লাহ দিয়ে প্রায়সুম (মাঝে মাঝে) লোক আইবারে লাগে বাগানে। ওনাদের যেন ফটো তুলে মন ভরে না’।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অতিরিক্ত লাভের কারণে অনেকে আরও বেশি করে ঝুঁকছেন গোলাপ চাষে। এক বিঘা গোলাপ থাকলে পরবর্তী সময়ে এর কলম দিয়ে চাষ বাড়ানো যায়। গোলাপের ডগা কেটে অনেকে কলমও বিক্রিও করছেন। প্রতিটি গোলাপের কলম ১৮ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়।
চারা জমিতে লাগানোর তিন মাস পর থেকে গোলাপ ফুল সংগ্রহ করা যায়। স্থানীয় চাষিরা জানান, একটি গোলাপ গাছ থেকে ২০ বছর গোলাপ পাওয়া যাবে। এক একবারে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০টি গোলাপ ফুল পাওয়া যায়। গাছ থেকে একদিকে গোলাপ ফুল সংগ্রহ করা হচ্ছে অন্যদিকে আবার নতুন কুঁড়ি বের হচ্ছে। তাই ১০ বিঘা জমি থাকলে প্রতিদিনই গোলাপ ফুল সংগ্রহ করা যায়।
তবে সব সময় গোলাপের দাম বেশি থাকে না। ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর ও শীতকালে গোলাপের চাহিদা অনেক বেশি থাকে। ৫০টি গোলাপ দিয়ে একটি গুচ্ছ তৈরি করা হয়।
শ্যামপুর গ্রামের গোলাপচাষি মিল্টন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিটি গোলাপ ৪ টাকা থেকে ৫ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। তবে ভালোবাসা দিবসে এ গোলাপের দাম পাইকারি বাজারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। আল্লাহ দিলে ভালোবাসা দিবসের ১২ দিনে ৫ বিঘা জমিতে চার লাখ টাকার গোলাপ বিক্রি করতে পারবো। অন্য সময় বেচা-কেনা খারাপ হলেও ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি ও বিজয় দিবসে পুষিয়ে যায়’।
চাষিরা জানান, সুন্দর সুন্দর গোলাপ চাষ করতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয় তাদের। গোলাপের কলম লাগানোর আগে জমির মাটি এক হাত গর্ত করতে হয়। এরপর জৈব সার দিয়ে কিছুদিন জমি ফেলে রাখতে হয়। জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে জমিতে গোলাপের চারা লাগানো হয়। প্রতিমাসে একবার করে আগাছা পরিষ্কার করতে হয় গোলাপের জমি। নিয়মিত সেচ ও পরিচর্যা করতে হয়।
গোলাপচাষি মনসা চন্দ্র ভৌমিক বাংলানিউজকে বলেন, ‘ফুল চাষে অনেক কষ্ট। তারপরও ফুলে গরম ট্যাকা। গরমে থেকে জাড়ে(শীত) বেশি ফুল হয়’।
বিরুলিয়া ইউনিয়নে দুই দশক আগে থেকে শুরু হয়েছে গোলাপ চাষ। এখন অন্যসব মৌসুমি ফসলের জায়গা দখল করে নিয়েছে গোলাপ।
রহমত আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক সুম সবজিতে মারে(লোকসান হয়) কিন্তু গোলাপে মারে না’।
মরিচ, সবজি বিক্রির জন্য যেমন আড়ত আছে একইভাবে গোলাপ বিক্রির জন্যও। প্রতি সন্ধ্যায় সাদুল্লাপুর ও শ্যামপুরের তিনটি আড়তে শুরু হয় গোলাপ বেচা-কেনা। মূলত স্থানীয় পাইকাররাই ফুলগুলোকে পৌঁছে দেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
এতে করে চাষি থেকে শুরু করে বিরুলিয়া ইউনিয়নে অনেক ব্যবসায়ীর প্রধান জীবিকা গোলাপে। গোলাপ ফুল শুধু বিরুলিয়া ইউনিয়নের পরিবেশই গোলাপি করেনি। রক্ত রাঙা ও কালো গোলাপের স্পর্শে গোলাপি হয়েছে অনেকের কপালও।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
এমআইএস/এএসআর