ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

আবিদ চাচার শিমবাড়ি!

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, এনভায়রনমেন্ট স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
আবিদ চাচার শিমবাড়ি! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): তখন ক্লান্ত দুপুর। শীতের মিষ্টি রোদ তীব্রতা হারিয়ে চারিদিকে শেষ বেলার হাসি ছড়িয়েছে রেখেছে যেন।

দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমি, সড়কের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শতসহস্র ঢোলকলমির দল আর শুকনো পথের ধুলো- এ সবই আপন সখ্যতা গড়ে তুলেছে নিজেদের মাঝে।

বাইক্কা বিলের শান্ত কাঁচাপথ এঁকে-বেঁকে চলে গেছে মহাসড়কের দিকে। সে পথ ধরে ফিরে যেতে যেতে হঠাৎ দৃষ্টি গিয়ে থামলো সবুজ ঝোপের উপর। আরও কাছে এসে বুঝলাম না, একটি কোনো ঝোপ নয়, এটি আসলে সবুজ শিমে ঢাকা বাড়ি! এক কথায় বলা যায় শিমবাড়ি।
 
এত্ত সুন্দর! অবাক হলাম নিজেই! শিমগাছগুলো পুরো বাড়িকে ঢেকে রেখেছে। গভীর সন্তুষ্টি খুঁজে পেলাম কয়েকটি শিমকে নিজের হাতে স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে! 

কথা বলতে ইচ্ছে হলো এ শিমের উৎপাদকের সঙ্গে। বাড়িতে প্রবেশ করার পথে বাঁধ সাধলো নেটের জালগুলো। ওগুলো কিছুতেই আমাকে ঢুকতে দেবে না!

জালগুলোকে সেই বাড়ির চারদিকে দাঁড় করিয়ে শুকানোর প্রক্রিয়ার চলছে। তাতে হুট করে কেউ প্রবেশ করার জো নেই একদমই!

সেখানে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই একজন বৃদ্ধ জবাব দিলেন। দেখলাম তিনি সবেমাত্র দুপুরের খাবার খেয়ে হাত ধুতে পার্শ্ববর্তী পুকুরের পানিতে হাত ডোবালেন।    

নিজেকে আবিদ আলী বলে পরিচয় দিলেন। জানালেন, এই জমিটুকু দেখাশোনা করেন তিনি। জমির প্রকৃত মালিক হাজিপুরের জলিল মিয়া। মাসিক সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে তিনি এখানে হাওরের উন্মুক্ত প্রান্তরের বাড়িতে কাজ করেন।

শিম সম্পর্কে তিনি জানান, শিমগুলো তিনি নিজেই ছয়মাস আগে লাগিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে ৩/৪ কেজি করে শিম গাছ থেকে তোলেন। মালিকের বাসায় দেন, নিজেও কিছু খান। গোছো ইঁদুর শিমগুলো না খেলে আরও অনেক বেশি শিম হতো বলে প্রত্যাশা তার।

বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো ছয় সদস্যের পরিবারে আবিদ আলীই একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। ছোট দুই নাতি-নাতনিসহ ছেলে-পুত্রবধূ আর তিনি ও তার স্ত্রী। ছেলে অসুস্থ বলে বর্তমানে সংসারের বোঝা টানতে হচ্ছে তাকে।
 
আপনার শৈশবে এ জলাভূমিগুলো কেমন ছিল? প্রশ্ন জুড়ে দিতেই তার মুখ শৈশবস্মৃতির আবেগে রক্তিম হয়ে ওঠে। তিনি বলতে শুরু করেন, রাস্তার একদিকে জলাভূমি ছিল আরেক দিকে আমন ধানের খেত। আমি আব্বার সঙ্গে ধান কাটতে আসতাম। আর এখন সব জলাভূমিগুলো ধীরে ধীরে হ্যাচারি-ফিসারি হয়ে যাচ্ছে।
সকাল ৬টায় হাজিপুর গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে তার শিম বাড়িতে আসেন এবং সন্ধ্যায় আবার তার নিজ বাড়িতে ফিরে যান। এটিই তার বৃদ্ধ সময়ের দৈনিক কর্তব্য!

মঙ্গলবারের (২ ফেব্রুয়ারি) বাইক্কাবিল যাত্রা সার্থক হলো শিমবাড়ি দেখে।

তিনি যখন নিজের হাতে লাগানো শিমগুলোর উপর আঙুল স্পর্শ করলেন মুহূর্তে অনুভব করলাম এ যেন বাবার পরশ সন্তানের উপর!

আমাদের গ্রামবাংলার বয়োবৃদ্ধরা এখনো এভাবেই তবে জেগে থাকেন প্রতিটি সংসারের একমাত্র অবলম্বন হয়ে, প্রতিটি সংসারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অগ্রপথিক হয়ে!

দিন গড়াবে। আরেকটু বুড়োও হবে পৃথিবী। আবার কোনো একদিন বাইক্কা বিলের এলে পথে হয়তো আবিদ চাচার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।  

বাংলাদেশ সময়: ০২২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৬
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।