পাথরঘাটা (বরগুনা) থেকে ফিরে: বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রামের ১২ বছরের শিশু মো. কাওছার ও তার ছোট ভাই ৮ বছরের তাওহীদ এবং চরদুয়ানি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানি গ্রামের ১৫ বছরের কিশোর রেজাউল ও ১৪ বছরের শাকিল। এই বয়সেই দক্ষ জেলে ওরা, মাছ শিকারে পটু, জাল তৈরি-মেরামত-সংস্কার আর বাগি (জাল বায় যারা)- কোনো কাজেই পিছিয়ে নেই।
প্রয়োজনে গভীর সমুদ্রে যেতেও ভয়-দ্বিধা নেই এসব শিশু-কিশোরদের।
বঙ্গোপসাগর-বলেশ্বর-বিষখালীর উপকূল আর পায়রার মোহনা ও সুন্দরবন তীরের পাথরঘাটা। এখানকার বিশ শতাংশ মানুষ শূন্যভোগী (বিনিয়োগ করতে না পারা হতদরিদ্র) জেলে সম্প্রদায়ের হলেও আশি শতাংশ কোনো না কোনোভাবে মৎস্যজীবী। তবে সিডর বিধ্বস্ত এ উপকূলীয় জনপদের দুই লাখ বাসিন্দার শতভাগেরই অর্থনীতির চাকা ঘোরে ইলিশ আর পানির জোরে।
জেলেদের মধ্যে অনেকেই শিশু-কিশোর, যাদের ছোট্ট কাঁধে বর্তেছে পরিবার নির্বাহের বড় দায়িত্ব। মাত্র ৭-৮ বছর বয়সে মাছ শিকারে হাতেখড়ি হয় ওদের। এরপর ২/৩ বছরের মধ্যেই একেকজন দক্ষ জেলে হয়ে ওঠে আর পানিতে নেমে পড়ে মাছ ধরতে।
পরিবারের অভাব-অনটন আর পেটের দায়ে বাপ-দাদার পেশায় নামার কোনো বিকল্পও ওদের সামনে।
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত এই শিশু-কিশোরদের ভাষ্য- ‘মোগো বাপ-দাদায় পানির কাম হরছে। মোরাও হিখছি একটাই কাম, এই কামই জানি। ভাতের অভাবে-টাকার অভাবে নদী-সাগরে নামতেই অইবো। না অইলে বাঁচমু কেমনে?’
বছরখানেক আগে কাওছার-তাওহীদ ও তাদের অসুস্থ মা হালিমাকে ফেলে চলে গেছেন বাবা। সংসারের ভার এখন বড় ছেলে কাওছারের কাঁধে। ছোট ভাই তাওহীদকে নিয়ে তাই ভিড়তে বাধ্য হয়েছে মাছ শিকারের পেশায়। ছোট্ট দুই ভাইয়ের সারাদিনের হাড়ভাঙা খাঁটুনিতে চলে তিনজনের সংসার।
মাছ ধরা ট্রলারে বসে জাল বুনতে বুনতে তাওহীদ ও কাওছার বলে, ‘কাম না হরলে মোরা খামু কি? মোগো কেউ খাওন দেবে না। মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই মোগো। বাবা এক বছর আগেই মোগো হালাইয়া গ্যাছে। এক খেও মারলে ৪/৫শ’ টাহা পাই। তাই দিয়ে মায়রে নিয়ে প্যাড চালাই’।
হতদরিদ্র জাফর জমাদ্দারের বড় নৌকা বা ট্রলার গড়ে সাগরে-নদীতে নামার সাধ্য নেই। তাই ছেলে রেজাউল ও অন্য একজনকে নিয়ে ছোট্ট নৌকায় বলেশ্বরের খালে-কূলে বড় জোর মাঝ নদী পর্যন্ত যান। পুঁজির অভাবে দিনে গিয়ে রাতেই ফিরেও আসতে হয়।
১০ বছর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে থাকছে রেজাউল। এখন সে নিজেই জাল বাইতে পারে।
রেজাউল বলছিল- ‘বাপের টাহা-পয়সা নাই। তাই লেহাপড়া শিখাইতে পারে নাই, মাছ ধরতে শিখাইছে’।
বলেশ্বর পাড়ে বেড়িবাঁধের পাশের খালে বাবার নৌকা-জাল মেরামতে সাহায্য করছিল নৌকার মালিক-মাঝি (সরদার) দেলোয়ারের ছেলে শাকিল। অল্প বয়সে জেলে হওয়া এ কিশোরও বলে- ‘সবকিছুই প্যাডের দায়ে করতে হয়। তাই মৌসুম জুড়ে নদীতে যাইতে হয়’।
পদ্মা গ্রামের উনিশ বছরের রিপনের মাছ ধরতে পানিতে নামা শুরু আরো চার বছর আগে থেকে। বলেশ্বর পার হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়া বড় ভাই মো. জালালের ট্রলারের সঙ্গীও হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা রিপন বলছিল- ‘মোগো বাঁচতে অইলে পানির লগেই যুদ্ধ হরতে অইবে। তাই ছোড থাকতেই বাপের লগে পানিতে নামছি, অহন বড় ভাইয়ের লগে’।
একই গ্রামের আব্বাসের সঙ্গে বছর দশেক আগেই মৎস্যজীবীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন জালাল। ‘এ কাম না করলে নিজের ও পরিবারের লোকজনের প্যাডে কি দিমু? বাইচ্চা থাকতে অইলে তো প্যাড ঠাণ্ডা রাখতে অইবোই’- ২৫ বছরের এই দুই যুবকের বক্তব্যও অন্যদের মতোই।
প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাঁধে এভাবেই পড়ছে জালের জোয়াল। নৌকা-ট্রলার নিয়ে নিয়ত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর-নদী-খাল আর সুন্দরবনের কূলে মাছ ধরে পরিবার ও নিজেদের পেটের দায় মেটাতে হচ্ছে ছোট্ট হাত দিয়েই।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৬
এএসআর
** জলদস্যুরা সর্বহারা পেশাছাড়া করছে জেলেদের
** পানির দেশে পানির আকাল!
** ইলিশ এলে জাগবে পাথরঘাটা, অপেক্ষায় মানুষ
** ‘প্যাড বাঁচাইতে বাঁচাইতে শ্যাষ, পিঠও বাঁচবো না’
** সেই কালরাতের ক্ষতচিহ্ন মোছেনি এখনও
** পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ!