প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা উপকূলের জেলেজীবন। সমুদ্রে দস্যু আর দুর্যোগের আতংক কাটিয়ে কিনারে ফিরতে না ফিরতেই পড়তে হয় দাদনদারদের কবলে।
উপকূল-অঞ্চল ঘুরে এসে: পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরেন না। ঝড়ের ঝাপটায় কিংবা দস্যুদের কবলে পড়ে দিতে হয় প্রাণ। দিনের পর দিন মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও স্বজনেরা জানতে পারেন না নিখোঁজ জেলের সন্ধান। এভাবেই নি:স্ব জেলে পরিবারটি পথে বসে যায়। সংসারের পুরো বোঝা এসে পড়ে অসহায় দিশেহারা জেলে-বধূর দুর্বল কাঁধে।
উপকূলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জেলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নানান তথ্য মেলে। ভোলার দৌলতখান, চর চন্দ্র প্রসাদ, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, নোয়াখালীর হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জে বহু স্বজনহারা পরিবারের দেখা মেলে। জীবিকার টানে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হারিয়ে যাওয়া জেলের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। প্রিয় স্বজনের মরদেহ পাওয়া তো দূরের কথা, খবরটি পর্যন্ত পাওয়াও অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে।
সরেজমিন ঘুরে বাংলানিউজ জানতে পারে, এই জেলে পরিবারগুলোর জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। পারিবারিক স্থিতি-স্বস্তি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। বিধবা জেলেবধূ কখনো শ্বশুরের সংসারে বোঝা, আবার কখনো বাবার বাড়ি গিয়ে বাবার সংসারে ঝামেলা। অনেকে আবার জীবিকার কোনো পথ না পেয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। অতিকষ্টে ধার-দেনা করে, কিংবা আশাপাশের স্বচ্ছল পরিবারের কাছে চেয়েচিন্তে কোনোমতে বেঁচে থাকতে হয় এদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্ঘটনার পর ট্রলার মালিকের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই এইসব জেলে পরিবারের জন্য। কেউ কেউ হয়তো আশ্বাস দেয়, কিন্তু সেই আশ্বাস আর পূরণ হয় না।
ভোলা জেলাসদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চর চন্দ্রপ্রসাদ গ্রাম। স্বামী হারিয়ে বিধবা এই গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৪০)। স্বামী বজলু মাল ৫ মেয়ে রেখে গেছেন। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবের কবলে পড়ে আর ফিরে আসেন নি। সেই থেকে মনোয়ারার জীবনে নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা। স্বামীর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও এখনও অপেক্ষা শেষ হয়নি অসহায় এই নারীর।
স্বামী হারানোর পর জীবনের পুরো পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার গল্প জানাচ্ছিলেন মনোয়ারা।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, তার মেয়েদের সবাই স্কুলে যাচ্ছিল। কিন্তু স্বামী হারানোর পর আর্থিক সংকট বেড়ে যাওয়ায় তিন মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কাজে পাঠাতে হয়েছে। স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন।
একই গ্রামের জসিম উদ্দিনের স্ত্রী জেসমিন আক্তার, নূর উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন, আল আমীনের স্ত্রী জান্নাত বেগম, শহিদুল চৌকিদারের স্ত্রী আকলিমা আকতারসহ আরও কয়েকজন চরম সংকটে দিনাতিপাত করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের জীবন ওলটপালট করে দিয়েছে। মাছধরা ট্রলারের মাঝি জসিম উদ্দিনসহ ট্রলারে থাকা ১৫জন জেলের কেউই ফিরে আসতে পারেন নি। তাদের খবরটি পর্যন্ত আসে নি পরিবারের কাছে।
সরেজমিনে ভোলার দৌলতখানের ভবানীপুরে গেলে স্বজন হারানোর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখানকার জেলেরা জানান, মাত্র এক সপ্তাহ আগে ২৫ বছর বয়সী জেলে হান্নান মিয়া মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি। স্ত্রী আর দুটো ছোট সন্তান রয়েছে তার। বাবার সংসার থেকে মাত্র দুসপ্তাহ আগে আলাদা সংসার পেতেছিলেন হান্নান। স্ত্রী মুক্তা আক্তারের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার। পৃথক সংসার থেকে তিনি আবার শ্বশুরের সংসারে।
একই এলাকায় তিন বছর আগে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন ২২ বছরের যুবক রুবেল। বাবার মৃত্যুর পর রুবেলের কাঁধেই ওঠে সংসারের বোঝা। মা আর ভাই-বোনদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার দায়িত্ব ছিল তার। রুবেল হারিয়ে যাওয়ায় পরিবারটি চরম সংকটে পড়েছে।
সাত বছর আগে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেন নি দৌলতখানের বিবি হাজেরার স্বামী আবুল হোসেন। মাছ ধরতে যাওয়ার একদিন পরে পরিবারের কাছে খবর আসে তিনি ট্রলার থেকে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেন নি। এদিকে ছেলেমেয়ে নিয়ে বিবি হাজেরা দুর্ভোগে পড়েন। আবুল হোসেন সঞ্চয় কিছুই রেখে যান নি, যা দিয়ে সংকটের দিনগুলো চলবে। বরং স্বামীর দেনার বোঝাই বয়ে বেড়াতে হয় স্ত্রীকে।
সমুদ্রে মাছ ধরারত অবস্থায় দস্যুরা আক্রমণ চালিয়ে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে জেলেদের নদীতে ফেলে দেয়। এভাবে প্রাণ হারানো এক জেলে লক্ষীপুরের রামগতির মইনুদ্দিন। বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর। দেড় বছর আগে সমুদ্রে গিয়ে দস্যুদের কবলে পড়েন। রেখে যান স্ত্রী ইয়ানুর বেগম আর তিন বছরের মেয়ে বিবি রাফিয়াকে। স্বামীর ভিটেটুকুও নেই বলে ইয়ানুরের ঠাঁই হয়েছে রামগতির আসলপাড়ায় বাবার সংসারে।
ইয়ানুরের কাছে বৈশাখ মাসের ৫ তারিখটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। বিয়ের মাত্র পাঁচ বছর যেতে না যেতেই জীবনের এই ওলট-পালট অবস্থা। তিনি মেনে নিতে পারেন না। বাবাকে খুঁজে ফেরা মেয়ের কাছে তার নেই কোনো জবাব। ইয়ানুর জানেন না তার বাকি জীবনটা কীভাবে চলবে। বাবার সংসারের বোঝা হয়েই বা ক’দিন থাকতে পারবে।
রামগতির ট্রলারমালিক শরিফ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা যেমন ঝুঁকিতে থাকে, ট্রলারের মালিকদের ঝুঁকিও কোনো অংশে কম নয়। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রলারটি হারিয়ে গেলে ট্রলার মালিকের তো বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। এ অবস্থায় মালিকদের জেলেদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব হয় না।
ভোলা কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমিতির সম্পাদক আবুল কাশেম বাংলানিউজকে বলেন, মাছধরা ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখাটা জরুরি। কারণ জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মাছ ধরতে যায়। জেলে ফিরে আসতে না পারলেও তার পরিবার যাতে চলতে পারে সেরকম আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
সিরিজের শেষ পর্ব: জেলে পরিবারের শিশু, ষোলতেই দক্ষ মাঝি
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪
উপকূল থেকে উপকূল
উপকূল থেকে উপকূল
বিধবা জেলে-বধূদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার
রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।