ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জীবন-মৃত্যু যেখানে নিয়তি নির্ভর

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৫ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৪
জীবন-মৃত্যু যেখানে নিয়তি নির্ভর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাহেরচর, রাঙ্গাবালী, পটুয়াখালী থেকে : মুমুর্ষু রোগীকে নদীপথে জেলা সদরে পৌঁছাতে লেগে যায় বারো ঘন্টা। পাড়ি দিতে হয় ৭০ কিলোমিটার নদীপথ।

যথাসময়ে লঞ্চঘাটে যেতে না পারলে ভরসা ট্রলার। দুর্যোগ মৌসুমে রোগীর চিকিৎসায় স্বজনদের ভোগান্তির শেষ থাকে না।

এ চিত্র দেশের দক্ষিণে সমুদ্রতীরের উপজেলা রাঙ্গাবালীর। আগুনমুখা, রামনাবাদ, দাঁড়চিরা, ডিগ্রি, বুড়াগৌরাঙ্গসহ বেশ কয়েকটি ভয়াল নদী জালের মত ঘিরে রেখেছে এ উপজেলাটিকে। এখানকার মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও সেই মান্ধাতার আমলের হালেই চলছে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র দূরে থাক, একটা ভাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রও এখানে নেই।

রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর বাহেরচর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলছিলেন, রোগীকে ট্রলারে তুলে দিয়ে এখানকার মানুষ শুধু কাঁদে আর সৃষ্টিকর্তাকে ডাকে। মুমুর্ষু রোগীদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর। ১০-১২ ঘন্টার নদীপথ পাড়ি দিয়ে ডাক্তারের কাছ পর্যন্ত রোগী পৌঁছাতে পারবে কীনা কেউই বলতে পারে না।             

সরেজমিনে ঘুরে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, পটুয়াখালী জেলাধীন রাঙ্গাবালী উপজেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষ আধুনিক চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত। হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমবিবিএস ডাক্তার, কিছুই নেই এখানে। রোগী নিতে এ্যাম্বুলেন্স তো দুরের কথা, রিক্সা-টেম্পোর মত যানবাহনও নেই এখানে। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র তো দূরের কথা, সব ইউনিয়নে নেই ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। দু’একটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও তার অবস্থা শোচনীয়।

রাঙ্গাবালী ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি কাজ চলছে পুরানো একটি ভবনে। পরিকল্পনা সেবা আর শিশুদের অসুখ-বিসুখ ছাড়া এখানে বিশেষ কোন সেবার ব্যবস্থা নেই। ভবনে প্রবেশের আগেই মনে হবে এটা পরিত্যক্ত ভবন। কক্ষের ভেতরে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। যেন পরিস্কার করার কোন লোক নেই। ছাদ থেকে পানি পড়ে ভেসে যায় নিচের  ফ্লোর। দেয়াল থেকে খসে পড়ে পলেষ্টার। নেই কোন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। সন্ধ্যা হলে ভুতুরে পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

এই কেন্দ্রের উপ-সহকারি মেডিকেল অফিসার রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, এখানে শিশুস্বাস্থ্য, মৌসুমী কিছু অসুখ, গর্ভবতী মায়েদের সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বিষয়ক কিছু সেবা দেয়া হয়। জটিল সমস্যায় রোগীদের জেলা সদরে পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়।

বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে নিয়োজিত সাব এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার সুবির কুমার পাল জানান, এখানে কোন কেন্দ্র না থাকায় ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের কুটির শিল্পের একটি কক্ষে থাকেন তিনি। সোলার কোম্পানির মেসে খাই। চিকিৎসা সেবার কোন সুযোগ নেই এখানে।

রাঙ্গাবালী ইউনিয়নে নিয়োজিত অনুতোষ চন্দ্র দাস জানান, জেনারেটর ও অক্সিজেন সিলিন্ডার অকেজো থাকায় রোগীদের ভাল চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রয়েছে জনবলের অভাব।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রোগীকে বাঁচাতে চিকিৎসার জন্য যেতে হয় জেলা শহর পটুয়াখালী, বিভাগীয় শহর বরিশাল অথবা রাজধানী ঢাকায়। গরিব অসহায় মানুষের ভাগ্যে সে চিকিৎসা জোটেনা। তারা নিয়তির ওপর ভর করে দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে জেলা সদরে চিকিৎসার জন্য ছুটে। আর এই নদীপথে যাতায়াতের একমাত্র বাহন যাত্রীবাহী লঞ্চ।

রাঙ্গাবালী সদর, বড়বাইশদিয়া, চালিতা বুনিয়া, ছোটবাইশদিয়া ও চরমোন্তাজ ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে একটি করে একতলা লঞ্চ ছেড়ে যায় উপজেলা সদর গলাচিপা ও জেলা সদর পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে। এরপর সারাদিন ও সারা রাতের মধ্যে যাতায়াতের কোন ব্যবস্থা নেই। মুমূর্ষ রোগীকে পটুয়াখালীর যে কোন হাসপাতালে পৌছাতে সময় লাগে ১২ ঘন্টারও বেশি। লঞ্চের সময় পেরিয়ে গেলে একমাত্র ভরসা ইঞ্জিন চালিত নৌকা অথবা ট্রলার। এতে সময় ও খরচ দুটোই বেড়ে যায়।

সময়মত হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারায় পথেই অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটে। কাজির হাওলা গ্রামের দুলাল লাহারীর স্ত্রী সালমা বেগম, রাঙ্গাবালী গ্রামের ফিরোজ মৃধার স্ত্রী নাসিমা বেগমসহ অগণিত রোগী যোগাযোগ সংকটের কারণেই প্রাণ হারিয়েছেন। রাঙ্গাবালী থানার আফাজউদ্দিন নামে একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হৃদরোগে আক্রান্ত হলে পটুয়াখালী নেয়ার পথে ট্রলারেই মারা যান।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র সম্পর্কে জানাতে গিয়ে এলাকার বাসিন্দারা বলেন, এখানে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পথে ভ্যানগাড়ি কিংবা যাত্রীবাহী লঞ্চে সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনার তালিকা অনেক লম্বা হবে। সন্তান প্রসবের কোন ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি। এ কাজে নিয়োজিত পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নিয়োজিত আছে ঠিকই, কিন্তু জটিল সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা তাদের কাছে নেই।

সূত্র বলছে, ১৯৯১ সালের পরে রাঙ্গাবালী, ছোটবাইশদিয়া ও চরমোন্তাজে একটি করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে অদ্যাবদি কোন কেন্দ্র নির্মাণ হয়নি। চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নে বহু পুরাতন একটি আরডি (রুরাল ডিসপেনসারি) থাকায় ওখানেও কোন চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। নির্মিত কেন্দ্রগুলোতে চলছে নাম মাত্র চিকিৎসা। এতে নেই কোন এমবিবিএস ডাক্তার। অস্ত্রপ্রচার, প্যাথলিজিক্যাল পরীক্ষা, কোন ব্যবস্থাই নেই এতে।

বাংলাদেশ সময়: ০৩১০ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।