ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

সন্দ্বীপ কী আবার শূন্য দ্বীপে পরিণত হবে!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৪
সন্দ্বীপ কী আবার শূন্য দ্বীপে পরিণত হবে!

সেনের হাট, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম থেকে: ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দ্বীপ সন্দ্বীপ কী আবার শূন্য দ্বীপে পরিণত হতে চলেছে! এমন সংশয় সন্দ্বীপবাসীর মনে। যারা প্রাচীন সন্দ্বীপ দেখেছেন, তারা বর্তমান সন্দ্বীপের কথা ভেবে আতঙ্কিত না হয়ে পারেন না।



এককালের বিশাল হাটবাজার, ফসলি জমি, বাড়ি-ঘর, গাছপালা, পুকুর, মৎস্য খামারসহ অনেক কিছুই এখন আর এখানে নেই। প্রতিনিয়ত ভাঙন তাড়িয়ে ফিরছে এখানকার মানুষদের।  

ঐতিহাসিক সূত্র বলছে, শূন্যদ্বীপ থেকে এ দ্বীপের নামকরণ হয়েছিল সন্দ্বীপ। কথিত আছে, বারো আউলিয়ারা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এ দ্বীপটি জনমানব শূন্য অবস্থায় দেখতে পান। সময়ের বিবর্তনে শূন্যদ্বীপ থেকে এ দ্বীপটি সন্দ্বীপ নামে পরিচিতি পায়। আবার অনেক ঐতিহাসিক সোমদ্বীপ অথবা স্বর্ণদ্বীপ থেকে সন্দ্বীপের নামকরণ হয়েছে বলে দাবি করেন।     

সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে বাংলানিউজ দেখেছে এক একটি এলাকা ক্ষয়ে যাওয়ার চিত্র। ভাঙন ধেয়ে আসছে, এক একটি বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। ঘর-বাড়ি সরিয়ে মানুষজন নতুন বাঁধের পাশে ঘর বেধেছে। শখ করে লাগানো আম-জাম গাছ, অতি যতœ করে বাধানো পুকুর ঘাট, স্বজনদের কবরস্থান সবই চোখের সামনে বিলীন হতে দেখছেন এখানকার মানুষেরা।  

আলাপকালে ভাঙন কবলিত মানুষেরা বলেছেন, বছরে কয়েকবার করে বাড়ি বদলানোর ফলে তাদের জীবনে নেমে আসা অবর্ণনীয় দুর্দশার খবর নিতে কেউ আসে না। মাথা গোঁজার এক টুকরো ঠাঁই নেই বলে সেই ভাঙন কবলিত বেড়িবাঁধের ধারেই আশ্রয় নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা তাদের।

সারিকাইত, রহমতপুর, হরিশপুর- বাংলানিউজ যেখানেই তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেখানেই গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে চলেছে বছরের পর বছর। রহমতপুরের বয়স্ক ব্যক্তি শওকত হোসেন তর্জনি তুলে মেঘনার বুকে তার বাড়ির সীমানা দেখানোর চেষ্টা করছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলছিলেন, এই নদী সব নিয়ে গেছে। মহিষের হাল নেই, পুকুরের মাছ নেই, থাকার মতো এক টুকরো জমি নেই, শরীরে খেটে খাওয়ার মতো জোর নেই।

রহমতপুরের স্টিমারঘাট থেকে নদীর কিনার ধরে হরিশপুরের দিকে যেতে দেখা মেলে আরও অনেকের। সবারই এক কথা। সন্দ্বীপের অস্তিত্ব নিয়ে তারা শঙ্কিত। সম্পদশালী লোকজন এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেও একেবারে নি:স্ব মানুষগুলো কোথাও যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে বাঁধের কাছেই থেকে গেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। ভেঙে পড়া ঘরখানা টিকিয়ে রাখতে চারদিকে রশি টানা দেওয়া হয়েছে। ঘরের কাছে ভাঙন চলে এলেও তাদের ঘরটা অন্যত্র সরানোর সুযোগ নেই।

সন্দ্বীপের গ্রামে ঘুরলে চোখে পড়ে অসংখ্য নতুন বাড়ির ঠিকানা। অমুক সাহেবের নতুন বাড়ি, তমুক সাহেবের নতুন বাড়ি। দু’একটি সাইনবোর্ড দেখে হয়তো কিছুই ধারণা করা যাবে না। কিন্তু গ্রামের পর এমন সাইনবোর্ড দেখলে এ নিয়ে প্রশ্ন জাগে। আলাপে স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এই সাইনবোর্ড দিয়েই নদী ভাঙন কবলিত মানুষদের চিহ্নিত করা যায়। তবে এরা সম্পদশালী। যাদের টাকা আছে, তারাই নতুন জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছেন।    

সূত্র বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেখানে হু হু করে বাড়ছে, সেখানে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দ্বীপ সন্দ্বীপের আয়তন ও লোকসংখ্যা দুটোই দ্রুত গতিতে কমছে। আর এই নদী ভাঙনের কারণে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বহু অবকাঠামো হারিয়ে গেছে। এলাকাটি দিন দিন উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ছে।  

পরিসংখ্যান বলছে, এক যুগ আগে প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটারের সন্দ্বীপের বর্তমান আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে সন্দ্বীপের লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ উল্লেখ থাকলেও এগারো বছর পর ২০১২ সালে এখানে লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে আড়াই লাখে। দ্বীপ ছেড়ে শুধু দেশের অন্য জেলায় নয়, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকায়ও বসতি গড়েছেন এখানকার মানুষ।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মেঘনার ছোবলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে দ্বীপটি। এরই মধ্যে উপজেলার আমিরাবাদ, বাটাজোড়া, ইজ্জতপুর, দীর্ঘাপাড়, রুহিনী, ন্যায়ামস্তি ইউনিয়ন মেঘনার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। মোগল স্থাপত্যের স্মৃতিবিজড়িত চারিআনি বাজারে নির্মিত সাহেবানী মসজিদসহ পুরনো সন্দ্বীপ টাউনের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ভবন হারিয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে উপজেলা সদরের সরকারি বিভিন্ন অফিস-আদালত এরই মধ্যে দু’বার স্থানান্তর করা হয়েছে। ইলিশের বন্দর খ্যাত সারিকাইতের বাংলাবাজার, ফকির টনা শাহর মাজার সমৃদ্ধ কালাপানিয়া দীঘি এখন মেঘনার অথৈ পানির নিচে।

সারিকাইত ইউনিয়নের বাংলাবাজারের বাসিন্দা গুণধর জলদাস বলেন, এ ওয়ার্ডের বহু জেলে পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে বাঁধের পাশে বসবাস করছে। এখানে একটি ঐতিহ্যবাহী মাছের বাজার ছিল। ভাঙনে সে ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। জেলেদের এখন মাছ ধরে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। ভাঙন রোধে কোনো ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়েনি।  

ঐতিহাসিক সূত্র বলছে, সন্দ্বীপের ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে এ দ্বীপের কর্তৃত্ব নিয়ে একসময় পর্তুগিজ, মগ, বাংলার বারো ভূঁইয়া ও মোঘল-পাঠানরা যুদ্ধ করে বঙ্গোপসাগরের নীল জল রঞ্জিত করেছিলেন। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে রেনেলের ম্যাপ অনুযায়ী সন্দ্বীপের আয়তন ছিল ১ হাজার ৮০ বর্গকিলোমিটার। ভাঙনের মুখে বর্তমানে এর আয়তন দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭৫০ বর্গকিলোমিটার।

বহু ঐতিহ্যের নাম সন্দ্বীপ। এখানে সব ছিল। এখন কিছুই নেই। সন্দ্বীপ এখন নিজেই সব হারিয়ে ফেলেছে। তাইতো কিছু অর্থকড়ি জমা হলে এখানকার আদি মানুষেরাও সন্দ্বীপকে ছেড়ে চলে যান, ঘর বাঁধেন কোনো বড় শহরে।

বাংলাদেশ সময়: ০২২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।