ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোগান্তির পথ চলা!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৪
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভোগান্তির পথ চলা! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রহমতপুর, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম ঘুরে এসে: ভরদুপুরে নদী কিনারে সার বাঁধা মানুষ। একে একে উঠছে ট্রলারে।

কারও হাতে-মাথায় বোঝা, কেউবা ধরে আছে সঙ্গে থাকা নারী কিংবা শিশুর হাত। ট্রলারে করে পৌঁছাতে হবে নদীর মাঝখানে নোঙর করা স্টিমারে। সবারই গন্তব্য চট্টগ্রাম। অপেক্ষার পালা শেষে মানুষগুলো স্টিমারে ওঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

সন্দ্বীপ থেকে স্টিমারে চট্টগ্রাম যাওয়ার ভোগান্তিটা এমনই। বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীরা এসে জড়ো হয় রহমতপুর স্টিমারঘাটে। বেড়িবাঁধ থেকে অনেক দূর পায়ে হেঁটে নদীর কিনারে আসতে হয়। তারপর একটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে উঠতে হয় ট্রলারে কিংবা নৌকায়। স্টিমারে যাওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। তবে বর্ষা মৌসুমে যাত্রী-ভোগান্তি চরম আকার নেয়।

সন্দ্বীপ উপজেলা সদর নিউ কমপ্লেক্স থেকে সামান্য পশ্চিমে গেলেই রহমতপুর স্টিমার ঘাট। দেশের অন্যান্য স্থানের লঞ্চ কিংবা স্টিমারঘাট থেকে এটির চেহারা পুরোপুরি আলাদা। লঞ্চ-স্টিমার ঘাটের কথা মনে পড়লে কল্পনায় যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, এখানকার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। এখানে নেই টার্মিনাল, ঘাটে স্টিমার ভেড়ে না। মালবাহী ট্রলার থেকে মালামাল নামানো, কিছু দোকানপাট আর কিছু অপেক্ষমান যাত্রী দেখেই ধারণা করা যায় এটি যাতায়াতের কোন ঘাট।

চট্টগ্রামগামী যাত্রীরা রহমতপুর স্টিমার ঘাটে ভিড় জমাতে থাকেন দুপুরের আগে থেকেই। স্টিমারের নেই কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি। স্টিমারের নাম আর ধারণা করে একটা সময় যাত্রীদের জানাতে পারেন ঘাট ইজারা কর্তৃপক্ষের লোকজন। এর ওপর ভিত্তি করেই যাত্রী অপেক্ষা করেন ঘন্টার পর ঘন্টা। অবশেষে হাতিয়া থেকে এমভি আবদুল মতিন এসে পৌঁছায় রহমতপুর ঘাটে। যাত্রীরা ছোটে ঘাটের দিকে।

কাঠ আর বাঁশ দিয়ে বানানো সাঁকোটা এরই মধ্যে নরম কাদামাটিতে বসে গেছে। এর ওপরেই লাইন। অপেক্ষা ট্রলারের। ঘাট ইজারাদারের উদ্যোগে সাঁকো তৈরি আর ট্রলারের পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অভ্যাস না থাকলে সাঁকো থেকে ট্রলারে ওঠাটা একটু কষ্টকরই মনে হলো। নারী ও শিশুদের ওঠা তো আরও কঠিন। এভাবে একটার পর একটা ট্রলার ভরে যায়, নদীর মাঝখানে নোঙর করা স্টিমারে তুলে দিয়ে আসে।

যাত্রীরা জানালেন, শুকনো মৌসুম বলে স্টিমারে উঠতে সমস্যা একটু কম। বর্ষাকালে নদীর কিনারের এই শুকনো জায়গাটা যখন ডুবে থাকে, তখন যাত্রী ওঠানামার ভোগান্তি সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখন যাত্রীদের কেউ ছোট নৌকায়, কেউবা সাঁতরে নদীর এই কিনার পর্যন্ত আসে। এরপর ট্রলারে উঠে পৌঁছায় স্টিমারে।

চট্টগ্রামগামী যাত্রী শাহাদাত হোসেন বলেন, নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলার কারণে স্টিমার ঘাটে ভিড়তে পারে না। একারণে যাত্রীদের সুবিধার্থে এখানে একটি সী-ট্রাক দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি অধিকাংশ সময়ই অকেজো থাকে। দু’দিন সচল থাকলে তিনদিন থাকে বিকল। ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে। স্টিমারে যাতায়াত নিরাপদ হলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের সে পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। স্টিমারে উঠতে গিয়ে অনেকে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।   

রহমতপুর ঘাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি আবুল কাশেম বাংলানিউজকে বলেন, যাত্রীদের সুবিধার্থে ইজারাদারের পক্ষ থেকে সাঁকো তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ট্রলারে পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘাটের আশপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে চর পড়ায় স্টিমার ঘাটে ভিড়তে পারছে না।

সূত্র বলছে, সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য এটি অনেকটা নিরাপদ রুট। সমুদ্রের উপর দিয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলিতে ঢুকে এই স্টিমারগুলো। অনেক বড় জলযান হওয়ার কারণে সাধারণ ঝড়ঝাপ্টায় কোনো সমস্যা হয় না। চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ-হাতিয়া রুটে তিনটি স্টিমার চালু রয়েছে। আগে এই রুটের স্টিমার বরিশাল পর্যন্ত যেত। কিন্তু একদিকে যাত্রীসংখ্যা কম, অন্যদিকে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় হাতিয়া পর্যন্ত গিয়ে স্টিমার পুনরায় চট্টগ্রামের পথে ফেরে।

চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ-হাতিয়া রুটে স্টিমার চলাচলে সমস্যা নিয়ে বাংলানিউজ কথা বলেছে স্টিমার এমভি আবদুল মতিনের মাস্টার ইনচার্জ মোস্তফা কামালের সঙ্গে। এই পথে স্টিমার চলাচলে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসাবে তিনি নাব্যতা সংকটকেই উল্লেখ করেন। আর এই একটি মাত্র সমস্যার কারণে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে, আবার সময়েরও অপচয় হচ্ছে।  

মোস্তফা কামাল বলেন, সন্দ্বীপের সওতাল খালের নিকটে হরিষপুরের সীমানা পর্যন্ত নতুন চর জেগে উঠেছে। এর ফলে কমপক্ষে তিনঘন্টা জোয়ার পেলে সন্দ্বীপ ঘাটে যাওয়া সম্ভব হয়। তাও ঘাট থেকে অনেক দূরে নোঙর করতে হয়। এছাড়া ওই এলাকায় এলোপাথারিভাবে জেলেদের জাল ফেলার কারণে স্টিমার চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।

তিনি জানান, সন্দ্বীপ ঘাট থেকে দুই নটিক্যাল মাইল বাইরে হাতিয়া যাওয়া-আসার পথে প্রায় এক নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। চর নূর ইসলাম নামক স্থানে চার নটিক্যাল পথে নদীর নাব্যতার কারণে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।              
  
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com]

বাংলাদেশ সময়: ০৪৫০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।