ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

যেখানে বেঁচে থাকা নিয়তি নির্ভর!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৪
যেখানে বেঁচে থাকা নিয়তি নির্ভর! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর নিজাম, মনপুরা, ভোলা ঘুরে এসে : মানুষের বেঁচে থাকা এখানে পুরোটাই প্রকৃতি নির্ভর। পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে গেলে আশ্রয়ের খোঁজে উঁচু স্থানে কিংবা গাছের ডালে উঠতে হয়।



এখান থেকে ইচ্ছা করলেই মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার সুযোগ নেই। দুর্যোগের সময় এখানকার মানুষগুলো একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

জীবনের কোন ক্ষেত্রেই তাদের নিরাপত্তা নেই। অথচ এটাও বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড। নির্বাচন এলে এখানকার বাসিন্দারা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়। এখানকার মানুষদেরও কিছু অধিকার আছে।

সমুদ্র মোহনার ছোট্ট দ্বীপ চর নিজামের বাসিন্দারা এভাবেই তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের বিবরণ তুলে ধরছিলেন বাংলানিউজের কাছে।

সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে সেখানকার মানুষের অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তবে এই তালিকার মধ্যেও আবার প্রধান হয়ে ওঠে চরে যাতায়াতের রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সাইক্লোন শেলটার আর খাসজমি বন্দোবস্তের দাবি।   



উপকূলের জেলা ভোলার উপজেলা মনপুরার ছোট্ট দ্বীপ চর নিজামের অবস্থান সমুদ্রের মোহনায়। মেঘনা অববাহিকায় জেগে থাকা এই দ্বীপের পরই শুরু হয়েছে সমুদ্রের সীমারেখা। প্রতিদিন এই দ্বীপে যাতায়াতের কোন সুযোগ নেই। দিনগুনে এখানে যাতায়াত করতে হয়। মঙ্গলবার চর নিজাম থেকে যে ট্রলারটি চরফ্যাসনের বেতুয়া ঘাটে আসে, সেটি আবার চর নিজাম যায় শনিবার। আবার শনিবার যে ট্রলারটি চর নিজাম পৌঁছায়, সেটি বেতুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে মঙ্গলবার। বেতুয়া থেকে মনপুরা পৌঁছাতে আবারও মেঘনা নদী পার হতে হয়।

চর নিজামের বাসিন্দারা এটাকে সহজভাবে ‘বন্দি জীবন’ বলে উল্লেখ করলেন। তারা জানালেন, এখানকার মানুষ এক অর্থে বন্দি অবস্থায়ই বেঁচে আছে। কারণ এখান থেকে ইচ্ছা করলেই বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ৩-৪দিন পর পর যাতায়াতকারী ট্রলারও দুর্যোগের সময় বন্ধ থাকে। জরুরি প্রয়োজনে দ্বীপের বাইরে আসার কোন সুযোগ নেই এখানকার বাসিন্দাদের।

চর নিজামের জালিয়াখাল এলাকায় পড়ন্ত বিকালে চোখে পড়ে অনেক মানুষের ভিড়। শুকনো খালের ঘাটে বাঁধা কিছু মাছধরা নৌকা। পরেরদিন মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতিতে জেলেরা। ছিঁড়ে যাওয়া জাল মেরামতে ব্যস্ত কেউ কেউ। অনেকে আবার নৌকা মেরামত করছেন। কোন নৌকা থেকে আবার উড়ছে রাঁন্নার ধোঁয়া। এরইমধ্যে শিশুদের কোলাহল, খেলাধুলো। পাশে ফাঁকা পড়ে আছে চরের খাসজমি, দূরে বনের গাছপালা। এখানেই আলাপ কিছু মানুষের সঙ্গে।



সত্তর বছর বয়সী রফিকুল ইসলাম। এখন কোন কাজ করতে পারেন না। এখানে এসেছেন ‘৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর। এই সময়ে অনেক যুদ্ধ করেছেন। লড়াই করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে। এই প্রবীণ চরবাসী বলছিলেন, এখানের মানুষেদের আল্লায় বাঁচিয়ে রেখেছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় ঘরবাড়ি। বড় ঝড় হলে বাড়িঘর উড়ে যায়। মানুষদের আশ্রয়ের কোন স্থান নেই।

চর নিজামের কালকিনি বাজারের ঘাটে ভেড়ে ট্রলার। এই বাজার থেকে চরের ভেতরে যাতায়াত খুবই কঠিন। কিছুদিন আগে চরের ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা হলেও জোয়ারের পানিতে সে রাস্তার মাটি ভেসে গেছে। কাদাপানির কারণে রাস্তার কিছু অংশ দিয়ে হাঁটাচলা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় বাসিন্দারা কখনো বাড়িঘরের ভেতর দিয়ে, কখনো শুকিয়ে যাওয়া খাল পেরিয়ে যাতায়াত করেন।

চরে একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। একটি পুলিশ ফাঁড়ি আছে। রয়েছে বন বিভাগের একটি অফিস। সাইক্লোন প্রিপারডসেন প্রোগ্রাম (সিপিপি)’র আওতায় একটি ওয়্যারলেস থাকলেও সেটি বিকল হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। অথচ এই চরে বসবাস করছেন পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত অধিকাংশ সেবা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে এখানকার মানুষ।  



সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, চর নিজামের বাসিন্দারা সমুদ্রকেন্দ্রিক জীবিকা টিকে আছে। কেউ মাছ ধরে, কেউবা মাছের ব্যবসা করে। বছরের সারা মৌসুমই মাছ ধরা চলে, তবে বর্ষায় ইলিশ মৌসুমের আয়-রোজগার একটু বেশি। কিন্তু এবার ইলিশ না পড়ায় প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে চর নিজামের কালকিনি বাজার। চায়ের দোকানের আড্ডা, হাটবাজারে বেচাকেনা, এমনকি ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায় সবই নির্ভর করে ইলিশ পাওয়া-না পাওয়ার ওপর।

সূত্র বলছে, ১৯৬২ সালের দিকে এই চরে বসতি স্থাপন শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষেরা এই চরে স্থান নেয়। ১৯৮৫ সালে তৎকালীন সরকার প্রধান হেলিকপ্টারে একাধিকবার এই চরে এসে এখানকার বাসিন্দাদের সুবিধা নিশ্চিতকরণে নজর দেন। ৭০টি ভূমিহীন পরিবারকে ওই সময় তিন একর করে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়। তারা নিজেদের জমির দখল পেয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৪ সালে এখানে বন্দোবস্তকৃত ৪৫০ পরিবার তাদের নামে বরাদ্দকৃত দেড় একর করে খাসজমি বুঝে পাননি।

চরের ভূমিহীনেরা জমির দখল বুঝে পেতে চাইলেও এতে বাধা রয়েছে বন বিভাগের। এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের কালকিনি বিট অফিসার মো. আওলাদ হোসেন পালোয়ান বাংলানিউজকে বলেন, ২০০২ সালে চর নিজামকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই বিবেচনায় ২০০৪ সালে যে জমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে, তা বিধিসম্মত নয়।



মনপুরা উপজেলার উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড চর নিজাম। এ ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আবুল কাসেম বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার সব সমস্যার মূলে রয়েছে ভূমি বন্দোবস্তে জটিলতা। চরে বিপুল পরিমাণ খাসজমি পড়ে আছে। এ জমি ভূমিহীনদের বিতরণ করা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। এর পাশাপাশি যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ও এখানে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।