ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

নাগরিক সুবিধাবিহীন জনপদ!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪
নাগরিক সুবিধাবিহীন জনপদ! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর নিজাম, মনপুরা, ভোলা ঘুরে: একদিকে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ, অন্যদিকে তিন বেলা খাবার যোগাড়ের কষ্ট। এর ওপর অসুখে মেলেনা পথ্য, শিশুদের যাওয়া হয় না স্কুলে।

সব ধরনের নাগরিক সেবা থেকেই বঞ্চিত থাকছে দ্বীপের মানুষে।

মাঠ পর্যায়ে সরকারের সব দপ্তরের কার্যক্রম থাকলেও দ্বীপবাসীর কাছে অনেক দপ্তরের নাম অজানা। বিচ্ছিন্নতায় অবরুদ্ধ মানুষ কেন্দ্র থেকে থাকছে অনেক দূরে।  

ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর নিজামের মানুষ এভাবেই বেঁচে আছে। নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নানান কার্যক্রম থাকলেও এই দ্বীপে তার সামান্য পরিমাণও পৌঁছাচ্ছে না। নজরদারির অভাবে এখানে উন্নয়ন সুবিধা পৌঁছাচ্ছে খুবই কম। ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড হিসাবে এখানে যতটুকু উন্নয়ন হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না।

সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে চর নিজামের মানুষের অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়।

বাংলানিউজের কাছে তারা তুলে ধরেন নানা সংকটের বিবরণ। নদীতে মাছ ধরে কিংবা অন্য কোন কাজকর্মে তিনবেলা খাবার যোগাড়টা হয়তো কোনভাবে হচ্ছে, কিন্তু বড় কোন অসুখ হলেই তারা বিপাকে পড়েন। কয়েকজন হাতুড়ে ডাক্তারের উপর ভর করে আছে এই চরের পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ। তবে চরের হাতুড়ে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে লিখতে মানা চরবাসীর। কারণ এই ভরসাটুকু না থাকলে তারা আরও বিপদে পড়বেন।

চরের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত কালকিনি বাজারে ছয়জন চিকিৎসক আছেন। প্রত্যেকের রয়েছে ওষুধের দোকান। এদের কারও কোন ধরনের সনদ নেই। তবুও এরাই এখানকার ‘বড়’ ডাক্তার। কেউ কোন সমস্যায় পড়লেই ছুটে আসে এই ডাক্তারদের কাছে। এদের সম্পর্কে অভিযোগ তুললে আবুল কাশেম নামের একজন জোরালো প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আগে একজন এমবিবিএস দেন। তারপর এই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে লেখেন। ’

কালকিনি বাজারের পল্লী চিকিৎসক মোহাম্মদ উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার মানুষের সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রাখেন। আমরা কয়েকজন চরবাসীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারি মাত্র। এর চেয়ে বেশি কিছুই করার নেই। এখানে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকা খুবই জরুরি। ওয়ার্ড পর্যায়ে যে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা, তাও এখানে নেই।

চর নিজামের বাসিন্দা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রব বলেন, প্রায় আড়াই ঘণ্টা নদীপথ পেরিয়ে চর থেকে কিনারে যাওয়া যায়। সেখান থেকে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে আরও তিন-চার কিলোমিটার পথ। অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। এখানে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের জোরালো দাবি জানাচ্ছি।

মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুনীল চন্দ্র দাস বলেন, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ার কারণে চর নিজামের মানুষের কাছে যথাযথভাবে চিকিৎসা সেবা পৌঁছানো কঠিন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা সেখানে যাচ্ছেন এবং চরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এখানে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে।             
 
চর নিজামের বাসিন্দারা চিকিৎসার পরে শিক্ষা সমস্যার ওপর জোর দিলেন। তারা জানালেন, এখানকার বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না। আবার অনেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করতে না করতেই লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা স্কুলে পাঠানোর চেয়ে ছেলেমেয়েদের কাজে পাঠানোকেই বেশি লাভজনক মনে করেন। অন্যদিকে চরের একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মানও ভালো নয়।

চর ঘুরে এসব তথ্যের প্রমাণ মেলে। চরের মাঝগ্রামে চর নিজাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর সবচেয়ে ভালো ছাত্রছাত্রীও বলতে পারলো না দেশে কয়টি জেলা আছে। সঠিক জবাব দিতে পারেনি আমাদের বিজয় দিবস কবে। এমনকি অনেকে স্কুলের নামটিও ঠিকঠাক বলতে পারলো না। এ প্রসঙ্গে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাখ্যা, বাইরের লোক দেখে ওরা ভয়ে জবাব দিতে পারেনি।

বিদ্যালয় সূত্র বলছে, এখানে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩২৫ জন। এরমধ্যে শিশু শ্রেণীতে ৭০, প্রথম শ্রেণীতে ৭৫, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৬০, তৃতীয় শ্রেণীতে ৫০, চতুর্থ শ্রেণীতে ৪০ এবং পঞ্চম শ্রেণীতে ৩০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তবে প্রায় সব ক্লাসেই মেয়েদের সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে উপরের ক্লাসে এসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়।

চরের একটিমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন চারজন। এরমধ্যে প্রধান শিক্ষকসহ দু’জনের বাড়ি চরফ্যাসন উপজেলায়। চরে অবস্থান করে তারা ক্লাস করান। বাকি দু’জনের বাড়ি চর নিজাম। বিদ্যালয়টি কিছুদিন আগে রেজিস্টার্ড থেকে সরকারিকরণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের একটি ভবন পুরানো। আরেকটি নতুন ভবন করা হলেও এর নির্মাণ কাজ হয়েছে অত্যন্ত নিম্নমানের। ক্লাসের ভেতরে জমে আছে বালু।   
 
চরের বাসিন্দারা শিক্ষার মান বাড়াতে এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলমুখী করতে অবিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। একই সঙ্গে চরে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি এলাকাবাসীর।

[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।