ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

ফসলি জমি গিলছে বিদ্যুৎ প্রকল্প!

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪
ফসলি জমি গিলছে বিদ্যুৎ প্রকল্প! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চর নিশানবাড়িয়া, কলাপাড়া, পটুয়াখালী : উর্বর জমিতে ধানের ফলন একরে ১০০ থেকে ১২০ মন। একরে তরমুজের ফলন হয় ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার।

৮০০ একর জমিতে বছরে ফলতো কোটি কোটি টাকার সম্পদ। আউশ ও আমন ধান, তরমুজ, ডাল, মরিচ, সূর্যমুখী, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল হয় এই জমিতে। কিন্তু এই সোনা ফলা জমি চাষির হাত থেকে চলে যাচ্ছে সরকারি বিদ্যু‍ৎ প্রকল্পে।   

চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উর্বর এ এলাকাটি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের রামনাবাদ নদীর তীরে। এ ইউনিয়নে বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতাভুক্ত চর নিশানবাড়িয়া গ্রামের মানুষেরা জানান, এলাকার জমি অত্যন্ত উর্বর। এক একরে পাওয়া ধান বিক্রি করা যায় প্রায় ৮০ হাজার টাকার। প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত এক হাজার দুই একর জমির মধ্যে অন্তত ৮০০ একর জমিতে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কৃষি উৎপাদন হয়। বছরের কোনো সময়েই এ এলাকার জমি পতিত থাকে না।

সূত্র বলছে, কলাপাড়ার রামনাবাদ নদীর তীরে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ জন্যে এক হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ভূমি উন্নয়ন করা হবে। ল্যান্ড অ্যাকুইজেশন, ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন ফর পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট‘ শীর্ষক এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৮২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। গত ২১ অক্টোবর একনেক বৈঠকে এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে সরকারি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে আমদানিযোগ্য কয়লা পরিবহন, পানির প্রাপ্যতা, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারিগরি বৈশিষ্ট্য, কুলিং সিস্টেম ও পাওয়ার ইভাক্যুয়েশন, পরিবেশগত কারণ ইত্যাদি বিবেচনা করে প্রকল্প এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে।

গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে গ্রামবাসীর ভেজা চোখ, মলিন মুখ। মানুষগুলোর মন খারাপ। বাড়ির আঙিনায় কিংবা রাস্তার ধারে বসে একই ভাবনা, একই আলোচনা। অনেক কষ্টে পাওয়া ভিটে, শখের বাগান, হাজারো স্মৃতিঘেরা উঠোন, স্বজনের কবরস্থান, জীবিকার একমাত্র অবলম্বন উর্বর ধানক্ষেত, সবই ছাড়তে হবে। কথাগুলো মনে হতেই সবার ভেতরে আর্তনাদ-আহাজারি। যুগে যুগে গড়ে ওঠা সাজানো গোছানো সংসার-সমাজ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকার মানুষের অবস্থা এখন এমনটাই। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের আগেই তাপে পুড়ছে ছয় গ্রামের অন্তত ১৫ হাজার মানুষের জীবন। বাংলানিউজ সরেজমিন ঘুরে শুনতে পেয়েছে তাপবিদ্যু‍ৎ কেন্দ্র এলাকার মানুষের আহাজারি। প্রতিটি মানুষ যেন বাড়ি হারানোর শংকায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। একদিকে হারাতে হবে বাড়ি, অন্যদিকে হারাতে হবে রোজগারের পথ।   

সরেজমিনে চর নিশানবাড়িয়া গেলে ছয় গ্রামের বহু মানুষ জড়ো হন তাদের অভিযোগ জানাতে। প্রত্যেকের কাছেই এক একটা বড় বড় গল্প। সবাই বলতে চান নিজেদের কথা। কথার যেন শেষ নেই। সবার পক্ষ থেকে হয়তো একজন বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তো সব কথা উঠে আসে না। সে কারণে সবাই একটু একটু বলতে চান। বলা শেষ না হওয়ায় ওই এলাকা থেকে ফেরার পথে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেও একদল গ্রামবাসী তাদের আকুতি জানিয়ে গেলেন।   

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রকল্প এলাকার পূর্বে রামনাবাদ নদী, পশ্চিমে টিয়াখালী নদী, উত্তরে লোন্দা খাল, দক্ষিণে আন্দারমানিক নদী। ধানখালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চর নিশানবাড়িয়া, মধুপাড়া, গরাৎখা, মাছুয়াখালী ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দাসের হাওলা ও মরিচবুনিয়া এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। চর নিশানবাড়িয়া গ্রামে ১২০০, মধুপাড়া ২০০০, গরাৎখা ১৫০০, মাছুয়াখালী ৩০০০, দাসের হাওলা ৩৫০০ ও মরিচবুনিয়া গ্রামের ৩৫০০ মানুষকে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।

সূত্র বলছে, তাপবিদ্যু‍ৎ প্রকল্প এলাকায় রয়েছে ২০০ বাড়ি, ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা, ৮টি পাকা বাড়ি, ৮০০ একর কৃষি জমি, অন্তত ৫০০০ কবর। এই জমি প্রকল্পে আওতায় নিতে অন্তত ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অথচ সরকারের নীতিতে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে চর ও কম বসতির এলাকা বাছাইয়ের কথা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এ এলাকার পাশেই জাহাজমারার চর, চর মোন্তাজ, লতার চর, কাউয়ার চর এলাকায় এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হলে ক্ষতি অনেক কমে যেত। সরকারকে এতটা ক্ষতিপূরণও গুনতে হতো না।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ না করেই এই ঘনবসতিপূর্ণ বিপুল কৃষি সম্পদের এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগোচ্ছে।       

সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে চর নিশানবাড়িয়া, মধুপাড়ার বাসিন্দারা বলছিলেন, যেখানে প্রকল্পের সীমানা দেওয়া হয়েছে, তাতে সব বাড়ি সরিয়ে নিতে হবে। চর নিশানবাড়িয়া ও মধুপাড়ার পূর্বদিকের সীমানা ৫০০ ফুট পশ্চিমে এগিয়ে নিলে অনেকগুলো বাড়ি ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে পারে।

গ্রাম ঘুরে তথ্য সংগ্রহের সময় চোখে পড়লো চর নিশানবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাঁধের পাশে কোমলমতি শিশু কিশোরদের কোলাহলে মুখরিত এ বিদ্যালয়টিও এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। ফলে এসব শিশুদের অনেকের লেখাপড়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এমনটাই জানালেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।            

বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১০ অনুযায়ী, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫০ ভাগ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ১০২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।