কুয়াকাটা, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: বুনো শাকে জীবিকার দিন ফুরিয়ে আসছে। গাছপালা ধ্বংস হচ্ছে, বন-জঙ্গল হারিয়ে যাচ্ছে।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী রুশিয়া বেগম প্রায় ২০ বছর আগে থেকে বুনো শাক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। স্বামী আবুল হোসেন ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাকে এই পথে নামতে হয়। শাক কুড়িয়ে ঘরে ঘরে বিক্রি করে চাল-ডাল কিনে বাড়ি ফিরতেন। বেশ ভালোই কাটছিল তার দিন। কিন্তু সেদিন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত লাগোয়া গ্রামে আলাপকালে সেই হতাশাই প্রকাশ করলেন রুশিয়া।
এক নিঃশ্বাসে অনেক শাকের নাম বলে ফেললেন রুশিয়া। মামাকলা (জংলি পটল) গাছের পাতা, ঢেঁকি শাক, থানকুনি পাতা, কচুর লতি, কুমারী লতা, তিত বেগুন, কলমি শাক, হেলেঞ্চা শাক, ভাউত্তা শাক, চটা শাক, আগ্রা শাক, মুরমুইররা শাক, গোল হেলেঞ্চা শাক, অউদ্দা শাকসহ আরও কত শাকের নাম। আবার এসব শাকের গুণাগুণ সম্পর্কেও রুশিয়া সচেতন। বললেন, কুমারী লতার আগা সাপে খায়। মানুষের এই আগা খেলে সাপের বিষ নেমে যায়।
একসময় কুয়াকাটা এলাকায় প্রচুর পরিমাণ এসব বুনো শাক পাওয়া যেত। এই কাজে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে বুনো শাকের কদর অনেক বেশি। কোনো জংলি শাক বাঙালি সমাজে ততটা গুরুত্ব না পেলেও আদিবাসীদের মধ্যে ছিল ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু এখন রাখাইন জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কমে গেছে। শাক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহকারী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। ফুরিয়ে গেছে শাকের উৎসস্থলও।
রুশিয়া বললেন, এককালে কুয়াকাটার সম্পদশালী ব্যক্তি ফয়েজ মিয়া বন থেকে শাক কুড়িয়ে আনতে বলতেন। শাক এনে দিলে ফয়েজ মিয়া কয়েকটি নারিকেল দিয়ে দিতেন। তখন অনেক শাক পাওয়া যেত। এখন অনেক শাক আর দেখা যায় না।
তিনি জানান, কুমারী লতা, তিত বেগুন, অউদ্দা শাক, মুরমুইররা শাক অনেকটাই কমে গেছে। আগে বন-জঙ্গল ছিল। এখন অনেকটাই কমে গেছে। অনেক ঘুরে কিছু শাক পাওয়া গেলেও তার দাম ঠিকমত পাওয়া যায় না।
শুধু রুশিয়া বেগম নন, আরও কয়েকজন শাক কুড়ানির সঙ্গে দেখা হল কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত লাগোয়া গ্রামে। এদের সকলেই যে শুধু শাক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তা নয়। কেউ কেউ গাছের পাতা, ডালপালা ইত্যাদি কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করে চাল-ডাল কিনে ঘরে ফিরতেন। এক সময় ঘন সংরক্ষিত বন থাকলেও কুয়াকাটায় সে অবস্থা নেই। পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় ভবন নির্মাণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে সংরক্ষিত বন।
কুয়াকাটার আদি বাসিন্দা আবদুস সাত্তার বলছিলেন, কুয়াকাটা সৈকতের পাশেই ছিল ঘর বন। এই বনে কৈয়া লতা নামে এক প্রকারের লতা পাওয়া যেত। বাণিজ্যিকভাবে এই লতা দেশের বিভিন্ন স্থানে যেত। বেড়িবাঁধের দু’পাশেও ছিল ঘন জঙ্গল। এই বন-জঙ্গল একদিকে মানুষের জীবিকায় সহায়ক ছিল, অন্যদিকে ঝড়ের তাণ্ডব থেকেও রক্ষা করতো। সে দিন হারিয়ে গেছে। কুয়াকাটার আগেই সেই চেহারা এখন আর নেই।
আদিবাসী রাখাইন মং চুমিন তালুকদার বহু বছর ধরে কুয়াকাটার কেরানি পাড়ায় বসবাস করছেন। এই এলাকার অনেক পরিবর্তন দেখেছেন তিনি। আলাপকালে তিনি বললেন, এই এলাকা এক সময় জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। ১৯৬২ সালের ঝড়ে এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯৬৫ সালের ঝড়ে আরও ক্ষতি হয়। বেড়িবাঁধ না থাকায় ওইসব ঝড়ে বাড়িঘর, গাছপালা উড়িয়ে নিয়ে যায়। বহু মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ে। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া আসলে এভাবেই শুরু হয়। এরই পরিণতি আজকের বনহীন কুয়াকাটা।
তিনি বলেন, বনের অনেক বিষয়ের সঙ্গে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন সম্পৃক্ত। শুধুমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারের যোগান নয়, পুষ্টির উৎস হিসেবেও এই বন এই এলাকার মানুষের উপকারে আসতো। এখন আর সে দিন নেই।
থঞ্চুপাড়ার বাসিন্দা আদিবাসী রাখাইন কবিরাজ ময়েচিং বলেন, শুধু যে বন থেকে শাক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করা হতো তা নয়, ওষধি গাছের উৎস ছিল কুয়াকাটার বন। এককালে এখান থেকে সংগৃহিত ঔষধি গাছগাছড়া এখন অন্য এলাকা থেকে আনতে হয়। কুমারী লতা, মুরমুইররা লতার আগা শুধু তরকারি হিসেবে খায় না, এসব ওষধ তৈরিতেও কাজে লাগে। সে দিন হারিয়ে গেছে। এর সঙ্গে মানুষের জীবিকার ধরণও বদলে গেছে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com]
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৪