কুয়াকাটা, পটুয়াখালী ঘুরে এসে: সংরক্ষিত বন হলেও সংরক্ষণ বলতে কিছুই নেই। বহু বছরের পুরোনো বন যে যেভাবে পারছেন, ব্যবহার করছে।
গত পাঁচ-দশ বছর আগের বনের সঙ্গে বর্তমান বনের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না এলাকার বাসিন্দারা। বন রক্ষা নিয়ে তারাও এখন শঙ্কিত।
পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে পূর্বদিকে গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অবস্থা এমনটাই। শুধু গাছ কেটে বন ধ্বংসই নয়, এ বনের জমি দখলের পাঁয়তারা করছেন একশ্রেণীর দুষ্কৃতিকারীরা।
তারা বনাঞ্চল দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ক্রয় কিংবা বায়না সূত্রে জমির মালিক বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের কঠোর নজরদারিতে কখনো এসব সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়, আবার লাগানো হয়। এলাকার মানুষ এসব সাইনবোর্ড দেখে হতবাক। বনের মালিকানা তারা কীভাবে পেলেন বুঝতে পারছেন না স্থানীয় লোকজন।
সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহে গেলে গঙ্গামতি ও কুয়াকাটা এলাকায় বন বিভাগের আওতাধীন জমিতে এমন বহু সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। বছরের পর বছর এই সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে বন বিভাগের কোনো মাথাব্যথা নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, ছোটবেলা থেকে এখানে দেখে এসেছি বন। এখন এই মালিকেরা কোথা থেকে এলেন বুঝতে পারছি না। এ জমি বেচা-কেনাও বা কীভাবে হলো?
গঙ্গামতি লেকের ওপর গার্ডার ব্রিজ পেরিয়ে যেতেই দু’দিকে চোখে পড়বে বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড। দু’বছর আগে এসব ঝুলে ছিল বন বিভাগের গাছের সঙ্গে। এখন গাছপালার মাঝখানের জমির মালিকানা দাবি করে এসব সাইনবোর্ড লাগানো আছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এখানে মহিউদ্দিন গং নিজেদের নামে প্রথমে কয়েকটি সাইনবোর্ড গাছের সঙ্গে লটকে দেন। তাদের দেওয়া সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে, তাদের পাঁচ একর ১৩ শতক জমি রয়েছে। এর কয়েক মাস পরে আরও কয়েকটি সাইবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
বন বিভাগ সূত্র বলছে, গঙ্গামতি মৌজায় ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই ৭৬২৬ নম্বর গেজেটের মাধ্যমে ১১২৮ একর এবং ১৯৮৬ সালের ১১ জানুয়ারি ১৯১১ নম্বর গেজেটের মাধ্যমে ২১০ একর জমি বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল করা হয়। যার মধ্যে বাগান করা হয়েছে। তারপরও দুষ্কৃতিকারীরা এ বনটিতে অসংখ্য বার হানা দিয়েছেন। কেটে নিয়েছেন শত শত ছইলা ও কেওড়া গাছ।
সংরক্ষিত বাগানের মধ্যে কীভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি রয়েছে, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই। কিন্তু বন বিভাগেরও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত সাগর পাড়ের এ সংরক্ষিত বনাঞ্চল দ্রুত নিশ্চিহ্নের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ছোটবেলা থেকে এখানে যে বন দেখে এসেছি, তার কিছুই এখন নেই। সংরক্ষিত বন একদিকে পর্যটনের আকর্ষণ, অন্যদিকে সমুদ্র পাড়ের মানুষদের দুর্যোগের তাণ্ডব থেকেও বাঁচায়।
বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডে বেড়িবাঁধের বাইরে কিছু জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন থাকতে পারে। তবে বন বিভাগের গাছ কাটার কোনো সুযোগ নেই। এসব সাইনবোর্ড ইতোপূর্বে একদফা উচ্ছেদ করা হয়েছে। আবারও উচ্ছেদ করা হবে।
কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে সমুদ্রের তীর ধরে কিংবা বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে যেভাবে যাওয়া হোক না কেন, চোখে পড়বে গঙ্গামতির ধ্বংসযজ্ঞ। বনের গাছপালা যে যেভাবে পারছেন, কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। বনের ভেতরে চলে যাওয়া খালের পাশে গড়ে উঠেছে শুঁটকি পল্লী। এ পল্লীর বেশ কয়েকটি ঘর তৈরি করা হয়েছে বনের গাছপালা কেটে।
এতো ঝড়ঝাপটার পরেও গঙ্গামতি এলাকায় এখনও যেটুকু সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে, তা পর্যটক ও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। কুয়াকাটায় আসা পর্যটকেরা সমুদ্র তীরের সংরক্ষিত বনের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য অবলোকনের জন্য ছুটে যান বনের পাশে। কিন্তু এ সৌন্দর্যটুকু আর কতোদিন অবশিষ্ট থাকবে, তা নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয় লোকজন। বনাঞ্চলের ওপরে দুষ্কৃতিকারীদের নজর পড়ায় এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে শঙ্কায় সংশ্লিষ্টরাও।
বনের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে বনের ভেতরে কিছু বাড়ি-ঘরও চোখে পড়ে। এ বসতি বন ধ্বংস করছে। জীবিকার প্রয়োজনে অবাধে কাটা হচ্ছে সংরক্ষিত বনের গাছ। অন্যদিকে গরু-মহিষ চড়ানো থেকে শুরু করে নানা ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
গঙ্গামতি বনের কাছে বসবাসকারী স্থানীয় বাসিন্দারা প্রশ্ন তুলেছেন বন বিভাগের ভূমিকা নিয়েও। তারা বলেছেন, অবৈধভাবে স্থাপিত করাত কল বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বনবিভাগ। আর লেম্বুরচর, কুয়াকাটা বনাঞ্চলের অর্ধেকটা বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। সে বিষয়েও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এখন বাকি রয়েছে গঙ্গামতির মনোরম এই বনাঞ্চল।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিপন্ন সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বার বার জলোচ্ছ্বাস, ঝড়-ঝঞ্জা আঘাত হানছে এই সৈকতে। তার ওপরে অসৎ লোকের নজর পড়ায় গঙ্গামতি বনাঞ্চল দ্রুত নি:শেষ হতে চলেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে গঙ্গামতি লাগোয়া কাউয়ার চরের বনাঞ্চল ৯০ শতাংশ হারিয়ে গেছে। গঙ্গামতিও ধ্বংসের পথে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০১০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪