মহেশখালী (কক্সবাজার) ঘুরে এসে: দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর চারদিকে জাগছে নতুন চর। বছরে বছরে বাড়ছে উপজেলার আয়তন।
কক্সবাজারের সমুদ্র ও পাহাড় ঘেরা এই দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী ঘুরে চোখে পড়ে নতুন জেগে ওঠা খাসজমি দখলের নানা চিত্র। চর জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দখলদারদের নজর পড়ছে সেখানে।
ঘর তুলে, কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে নতুন জেগে ওঠা চর দখলে নেওয়ার চেষ্টা চলছে সর্বত্র। বন বিভাগ বনায়নের মাধ্যমে চর রক্ষার উদ্যোগ নিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হচ্ছে না।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, পাহাড় সমৃদ্ধ দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পাহাড় কাটা। পাহাড়ের মাটি নদীর পানির সঙ্গে মিলে ভরাট করছে নদী।
নদীর প্রবাহ বন্ধ করে জেগে উঠছে বিশাল চর। উপজেলার চরাঞ্চলে ২৫ হাজার একর খাসজমি রয়েছে। এ জমি দখলে নিতে দখলদারদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
উপজেলার সোনাদিয়া, ঘটিভাঙা, মাতারবাড়ী, ধলঘাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় চর দখলের দৃশ্য চোখে পড়ে। ওইসব এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝেও এ নিয়ে চরম ক্ষোভ রয়েছে।
জমিহারা ভূমিহীনেরা রাস্তার পাশে ঝুঁপড়িতে বসবাস করেন, আর প্রভাবশালী দখল করে নেন জেগে ওঠা নতুন জমি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, নতুন চর জেগে মহেশখালীর আয়তন বাড়ছে। কিন্তু এতে লাভবান হচ্ছেন প্রভাবশালীরা। মাছের চাষ, নানা ধরনের ব্যবসাসহ বিভিন্নভাবে নতুন চর দখলে নিচ্ছেন তারা। কোথাও নতুন জেগে ওঠা চরের চারদিকে ঘের দিয়ে মাছ শিকার করছেন তারা।
![](files/Upakol_inner_809099711.jpg)
গবেষণা সূত্র বলছে, প্রায় ২০০ বছর আগে ১৭৮৯ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলের অদূরর্তী সাগর দ্বীপ মহেশখালীর আয়তন ছিল মাত্র ১৮৮ বর্গকিলোমিটার।
১৮৮২ সালে দ্বীপটির ভূমির মোট আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০৪ বর্গকিলোমিটারে। মাতারবাড়ী, ধলঘাটা ও সোনাদিয়া চর জেগে ওঠার ফলে দ্বীপের উত্তরে এবং দক্ষিণে বড় হতে থাকে।
এক পর্যায়ে মহেশখালী দ্বীপাঞ্চল এলাকার আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৮৮ বর্গকিলোমিটার।
এতো গেল শুধু দ্বীপাঞ্চলের কথা। মহেশখালী মূল দ্বীপ ও সংলগ্ন শাপলাপুরের নুনাছড়ি প্রায় ২০০ একর, কুতুবজোমে সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গা মৌজায় প্রায় ৯০০০ একর, ধলঘাটার হাঁসেরদিয়া এলাকায় প্রায় ৯০০ একর, হোয়ানকের আমাবশ্য খালী মৌজায় প্রায় ৫০০০ একর, মাতারবাড়ী প্রায় ২০০ একরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় ২৫ হাজার একর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল জেগে উঠেছে।
নতুন চরাঞ্চলগুলো বছরে বছরে সম্পূর্ণরূপে মহেশখালীর মূল ভূ-ভাগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে দ্বীপটির আয়তন বাড়িয়ে তুলছে। ফলে সমুদ্র আর পাহাড় ঘেরা এই দ্বীপ পাচ্ছে ভিন্ন মাত্রা।
আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত ইনডেক্স জার্নাল ‘ওরিয়েন্টেল জিওগ্রাফার’ এ প্রকাশিত ‘স্টাডিজ অন জিওমর্ফোলজিক্যাল এনভাইরেন্ট অব দ্য মহেশখালী আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণামূলক নিবন্ধে দ্বীপ মহেশখালীর গঠন প্রক্রিয়াগত বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ২০০ বছর আগে ১৭৭৮ সালে মেজর রেনেলের মানচিত্রে মাতারবাড়ী চরের কোনো নাম নিশানা ছিল না। সোনাদিয়া চরের আয়তন ছিল মাত্র ১ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার।
১৮৯২ সালে ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়ার’ মানচিত্রে মাতারবাড়ীর আয়তন দেখানো হয় ২৫ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার এবং সোনাদিয়ার আয়তন ছিল মাত্র ১০ বর্গকিলোমিটার।
১৯৯৫ সালে নতুন দ্বীপ দু’টির আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটার এবং ৩১ দশমিক ০৫ বর্গকিলোমিটার।
ওই গবেষণামূলক নিবন্ধে আরও বলা হয়, মহেশখালীর মূল ভূখণ্ড বিগত ২০০ বছরে প্রায় ৪৪ শতাংশ বেড়েছে আর সমগ্র মহেশখালী বড় হয়েছে প্রায় ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
গবেষণা সূত্র বলছে, ১৭৭৯ সালে মহেশখালী চ্যানেলের গড় গভীরতা যেখানে ১৫-৩৩ মিটার ছিল, তা ১৯৮৩ সালে কমে ৯-২০ মিটারে পৌঁছায়।
১৯৯৯-২০০০ সময়কালে তা আরো কমে ৫-৮ থেকে ১০ মিটারে দাঁড়ায়। দ্বীপটির উত্তর পূর্বাঞ্চলের চ্যানেলটি একেবারেই সংকীর্ণ এবং অগভীর হয়ে পড়েছে। ভাটার সময় এ চ্যানেলটি প্রায় পানি শূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় ওই চ্যানেল উত্তর দিকে কোনো নৌ-যানই চলাচল করতে পারে না।
মহেশখালী ও সংলগ্ন প্রায় একীভূত অন্যান্য চরাঞ্চলের মোট ৩১০ বর্গকিলোমিটার ভূমির প্রায় ৫০ বর্গকিলোমিটার বা ২৬ শতাংশ পাহাড়ি ভূমি (আদিনাথ রেঞ্জ), ৩৩ বর্গকিলোমিটার বা ১১ শতাংশ প্যারাবন সমভূমি, ৬৪ বর্গকিলোমিটার বা প্রায় ২১ শতাংশ অঞ্চল নবগঠিত উপকূলীয় জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত প্যারাবন ভূমি বা ম্যানগ্রোভ জোয়ার-ভাটাজাত সমভূমি এবং প্রায় ৮১ বর্গকিলোমিটার বা ২৬ শতাংশ অঞ্চল সক্রিয় জোয়ার-ভাটাজাত প্যারাবন সমভূমি।
দ্বীপটিতে বর্তমানে প্রায় ৬০ বর্গকিলোমিটার বা ২০ শতাংশ নতুন জেগে ওঠা কর্দম ভূমি, বালুকা বেলাভূমি অগভীর মগ্নচড়া গড়ে উঠেছে।
![](files/February_2015/February_02/Upakol_inner_2_228666177.jpg)
বিপুল পলালয়ন ও ভূ-গাঠনিক উত্থানের ফলে মাতারবাড়ি চ্যানেল, সোনাদিয়া খাল ও মহেশখালী চ্যানেল ক্রমে সংর্কীণ ও অগভীর হয়ে যাচ্ছে। এসব দ্বীপ ক্রমে একীভূত হয়ে মূল ভূ-ভাগের সঙ্গে মিশছে।
গবেষক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব ও আব্দুল হকের মতে, মহেশখালীর ভূমি গঠনের এ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মাত্র ১৫-২০ বছরের মধ্যে দ্বীপটি আয়তনে প্রায় দ্বিগুণ বড় হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মূল ভূ-ভাগের সঙ্গে এ দ্বীপের সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
মহেশখালী তৎসংলগ্ন অগভীর সমুদ্র অঞ্চলের বিচ্ছিন্নকারী মহেশখালী চ্যানেলে পাহাড় কাটার ফলে বিপুল পরিমাণে পলি সঞ্চালন হচ্ছে। এ কারণে পার্শ্ববর্তী নদীগুলো ভরাট হয়ে ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে আসছে— বলেও মনে করেন তারা।
গবেষকরা বলছেন, এছাড়া দ্বীপটির দক্ষিণ উত্তর ও পূর্বঞ্চলীয় অগভীর মহিসোপানের তলদেশ ক্রমে ভরাট হয়ে দ্বীপটি একদিকে যেমন দ্রুত আয়তনে বড় হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে মহেশখালী, কক্সবাজারের চকরিয়া-চিরিঙ্গা অঞ্চলের সঙ্গে উত্তর পূর্ব দিক দিয়ে যুক্ত হতে চলছে।
তাদের মতে, আগামী ১০/১৫ বছরের মধ্যেই মহেশখালীর মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে গোরকঘাটা জেটি থেকে চৌফলণ্ডি এলাকার মধ্যে এ দ্বীপটি সংযুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে মহেশখালীতে নতুন জেগে ওঠা চরের জমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দাবি জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
উপজেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দ্বীপের আয়তন বাড়ছে। নতুন জেগে ওঠা চরের জমি রেকর্ডভুক্ত হচ্ছে। এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগও রয়েছে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিনে ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরা-খবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com]
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫