ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

অরক্ষিত উপকূল-৬

মেঘনার বুকে ঝুঁকিতে দ্বীপ কলাতলী

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৩ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫
মেঘনার বুকে ঝুঁকিতে দ্বীপ কলাতলী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দুর্যোগ-দুর্বিপাকে উপকূলে বিপন্নতা বাড়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বাড়িঘর।

আশ্রয়হীনেরা ছুটে চলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বাপ-দাদার পুরনো ভিটে ছেড়ে দিয়ে মাথা গোঁজে বাঁধের ধারে। কারও ঠিকানা মেলে শহরের রাস্তার ধারে। কখনো জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, কখনো বা অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়া।

বর্ষায় ভাঙণের চিত্রটা এখন একেবারেই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপকূলে বাড়ছে এই দুর্যোগের ঝুঁকি। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসীর দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। ঝুঁকি বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। তবু উপকূল থেকে যায় অরক্ষিত। এইসব নিয়ে অরক্ষিত উপকূল শিরোনামে বাংলানিউজের আট পর্বে ধারাবাহিকের আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব...

উপকূলের বিপন্ন জনপদ ঘুরে: নদীর বুকে থই থই পানির ভেতরে ভাসছে ছোট ছোট ঘর। পাশ দিয়ে চলছে যাত্রীবাহী কিংবা মাছধরা ট্রলার-নৌকা। বাড়িঘরগুলোর পাশেই জাল ফেলছে জেলেরা। দূর থেকে ট্রলারে আসা কিছু যাত্রী পানিতে লাফিয়ে পড়ে ছুটছেন বাড়ির দিকে।

বাড়ি ফেরার পথে কোমর কিংবা বুক সমান পানি। নদী-নালা, ফসলি মাঠ, হাঁটাচলার পথ সবই পানির নিচে। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এটা চরের বসতি এলাকা।

এটা উপকূলের দ্বীপ মনপুরার অধীনে আরেকটি দ্বীপ চর কলাতলীর গল্প। সরেজমিন ঘুরে চর কলাতলীর বিচিত্র সব তথ্য পেয়েছে বাংলানিউজ। প্রকৃতির ওপর ভর করে ছকে বাঁধা এখানকার মানুষের জীবন। চর থেকে বাইরে কোথাও যেতে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ডিজিটালের এই যুগেও মেঘনা বুকের এই দ্বীপ সংযুক্ত হতে পারেনি কেন্দ্রের সঙ্গে। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া।

পড়ন্ত বিকেলে চরে নেমে দেখা গেল, জোয়ারের পানিতে আটকে পড়া মানুষেরা ঘরে ফিরছেন। জোয়ারের পানি বাড়লে চরের সব মানুষ বন্দি হয়ে পড়ে। কারও কোথাও যাওয়ার সুযোগ থাকে না। কেউ হয়তো বাজারে এসেছিলেন সদায়পাতি নিতে। কিন্তু জোয়ারের পানি তাকে আটকে দিল। বাড়িতে যেতে জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষা করতে হবে। সেজন্যে জোয়ার এখানকার মানুষদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করছে।

চর কলাতলীর পূর্বপ্রান্তে আবাসন বাজার। প্রায় দশ বছর আগে ভূমিহীন পরিবারের পুনর্বাসনে এখানেই সর্বপ্রথম সরকারি আবাসন নির্মিত হয়। এখানে গড়ে ওঠা বাজারটি আবাসন বাজার হিসাবে পরিচিতি পায়। তবে, সাম্প্রতিক এই বাজারটি চেয়ারম্যান বাজার নামে পরিচিতি পেয়েছে। চরের ছোট্ট বাজার। জেলে, কৃষক, মজুরসহ খেটে খাওয়া সংগ্রামী অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ এই বাজারে।  

বাংলানিউজের প্রতিবেদনের জন্য চরে তথ্য সংগ্রহে যাওয়ার খবরে চরবাসীর মনে উঁকি দেয় নানান কষ্টের কথা। অনেক সমস্যার মাঝে প্রধান সমস্যাটিই যেন চিহ্নিত করতে পারেন না তারা। কেউ এক নম্বরে আনেন ভূমি বন্দোবস্ত না হওয়ার সমস্যাকে, আবার এক নম্বরে রাখতে চান বেড়িবাঁধ না থাকার সমস্যাকে। আরও আছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ বিচ্ছিন্নতার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা। আলাপে লম্বা হতে থাকে সমস্যার তালিকা।  

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, চর কলাতলীতে এমবিবিএস তো দূরে থাক, একজন পল্লী চিকিৎসকও নেই। মানুষ এবং পশুপাখির চিকিৎসা করেন ওষুধ বিক্রেতারা। এমনকি এদের কেউ কেউ কবিরাজের কাজও করেন। এলাকার মানুষের এতেই সন্তুষ্টি। কারণ চিকিৎসার এই সুযোগটুকুও তাদের হাতের নাগালে নেই। এই তথ্য দিতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বার বার নিজেদের অসহায়ত্বের চিত্রই তুলে ধরেন।    

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চরে চারটি বাজার রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ এইসব বাজারে ছুটে। কিন্তু সেখানে প্রয়োজনের সবটুকু মেলে না। বাজারগুলোতে নেই এক ইঞ্চি পাকা সড়ক। জোয়ারের পানি বাড়লে চরের সবচেয়ে উঁচু বাজারও ডুবে যায়। প্রায় ২০ হাজার মানুষের বেড়িবাঁধহীন এই চরে একটিমাত্র সাইক্লোন শেলটার নির্মিত হচ্ছে।

আশ্রয়ের জন্য একটি মাটির কেল্লাও নেই। আর এসব থেকেই বা কী লাভ হবে, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই খারাপ, আশ্রয়ের সন্ধানে আসতে গিয়েও ঘটতে পারে বড় বিপদ।   

সূত্র বলছে, চারদিকে মেঘনা নদী বেষ্টিত চর কলাতলীর বয়স খুব বেশি নয়। মনপুরা উপজেলার মনপুরা ইউনিয়নের কলাতলী এলাকা ভেঙে সৃষ্টি হয় নতুন চর। এর নাম হয় চর কলাতলী। এখানে বসতি শুরু ২০০৪ সালের দিকে।

মানচিত্রে মনপুরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড হিসেবে চিহ্নিত এই চরটি। এ দ্বীপের প্রায় ২০ হাজার মানুষের মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ট্রলার-নৌকা। এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করে জেলা কিংবা উপজেলা শহরে। উপজেলা থেকে কিংবা ইউনিয়ন সদর থেকে চর কলাতলী যেতে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।   

গোটা চরে বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যা হলে সৌর বিদ্যুৎ আর জেনারেটরের আলোতে আলোকিত হয় এ বাজার। জমে ওঠে চরের বাজারের ব্যতিক্রমী মিলনমেলা। কিন্তু রাত এগারোটা বাজতে না বাজতেই আলো নিভে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে মানুষ, নিরব হয় চর কলাতলী।           

মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, চারদিকে বেড়িবাঁধ না থাকায় চর কলাতলী জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছে। ফলে সমস্যাও বাড়ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আগে ভূমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এরপর বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।

চেয়ারম্যান জানান, বেড়িবাঁধের দাবিতে বহুবার আবেদন করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব মনপুরা এলে তাদের কাছে আবারও আবেদন জানানো হয়েছে। তারা হেলিকপ্টারে ঘুরে চর কলাতলীর জোয়ারের প্লাবন দেখেছেন।

পানিসম্পদ মন্ত্রী চর কলাতলীকে একটি পোল্ডারের আওতায় আনার জন্য ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন।     
  
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোনো খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫
আরআইএম/পিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।