কলাপাড়া, পটুয়াখালী: জীবনের গতি বদলে দেয় শিশু বিয়ে। আলো থেকে অন্ধকারে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে ছুটে চলে জীবন।
এমনই এক ঘটনার সন্ধান মিলল পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। ঠিকভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারলে মেয়েটির এ বছর সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার কথা। বই হাতে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন তাকে বইতে হচ্ছে সংসারের বোঝা; যে বোঝা বয়ে চলার মতো শক্তি-সামর্থ কোনটাই নেই তার। বয়স হয়নি বলে বিয়ের কাবিন হয়নি। অথচ রেজিস্ট্রি ছাড়া বিয়ে হওয়ার কথা নয়। এক বছরের সংসারে মেয়েটি আবার তিন মাসের অন্তঃসত্বা। কিন্তু সেটা কোনভাবেই অনুভবে আসেনি এই কিশোরীর। কারণ, সংসার করা কিংবা বাচ্চা ধারণ করার বয়স তার এখনও হয়নি।
কিশোরীর নাম নিপা। স্বামীর নাম ইলিয়াস হোসেন। বয়স আনুমানিক ১৬-১৭ বছর। নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই। যখন যে কাজ পায়, তা-ই করে। এখন করছে মাটি কাটার কাজ। ইলিয়াসের বাবা ও মা দু’জনই অসুখে শয্যাশায়ী প্রায় তিন মাস ধরে। ফলে সংসারের পুরো বোঝাটা চাপল শিশুবধূ নিপার ওপর। এক বছর আগে পাশের লালুয়া ইউনিয়নের মঞ্জুপাড়া গ্রামের জেলে লোকমান মৃধার চার সন্তানের মধ্যে মেঝো নিপার সঙ্গে বিয়ে হয় ইলিয়াসের। আর ইলিয়াস বালিয়াতলী ইউনিয়নের আইয়ুম পাড়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ রফেজ খানের ছেলে।
বুঝে না উঠতেই শিশু বয়সে বিয়ে নিপার। সংসারের ধকল বইয়ে বেড়াতে গিয়ে নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা মনে নেই। মনের কোনে কোন আকাংখা জমাট বাঁধেনি। সুযোগও হয়নি। বিয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই শ্বশুড় বাড়ির কাজে প্রবেশ। বিয়ের এক বছরে অলঙ্কার বলতে একটি নাকফুল। কানে একটি এমিটেশন। এটা কতখানি সুখ কিংবা দুঃখের, সেটা ভেবে দেখার সময়ও হয়তো পায়নি নিপা। তবে তার চোখে-মুখে দৃশ্যমান সকল কষ্টের ছাপ।
কথাবার্তায় অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার ছাপ নিপার। কাঁথা সেলাই করে। রান্নার কাজ সামাল দেয়। এরই সঙ্গে করছে অসুস্থ শাশুড়ির সেবা, দেখাশোনা। কিশোরী এ বধুর উপর রয়েছে শ্বশুর-শাশুড়ির নিরেট আদর। ষষ্ঠ শ্রেণীতেই লেখাপড়ার পাঠ শেষ নিপার। তবে সেই দৃশ্য তার মনে এখনও দাগ কাটে। নিজের অজান্তে এখনও সহপাঠীদের কথা মনে জাগে তার। এখনও বই-খাতার ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায় এমন একজন ফাহিমার কথা মনে আছে জানায়- এ কিশোরী বধূ।
অকপটেই কিশোর স্বামী ইলিয়াস জানায়, বছরে ছিট কাপড়ের দু’টি সেলোয়ার কামিজ কিংবা একটি ভালো স্যান্ডেল দেয়ার সঙ্গতি নেই তার। নিজের অক্ষমতার জন্য নিজেকেই দায়ী করল এ কিশোর ইলিয়াস। ভারী একটি বোঝা মাথায় নেয়ার সময় মেরুদন্ডে আঘাত পায়। এখনও কঁকিয়ে ওঠে কাজ করতে গেলে। বছর খানেক আগে তার এমন দশা হয়েছে। মাটি কাটার কাজ করতেও সমস্যা হয়। ছেঁড়া, রংচটা একটি শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিপার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রীর সুখের জীবন কী? কী জীবনের চাওয়া-পাওয়া? কী তাদের জীবনের পরিকল্পনা? কী-ই বা করণীয়? কোন প্রশ্নের জবাব নেই এই দপ্ততির কাছে।
গর্ভে সন্তান আসার বিষয়টি অনুমান করতে পারেনি নিপা। শরীর খারাপ হওয়ার কারণে একবার গ্রামের পল্লী চিকিৎসক নূরুল কবিরের কাছে গিয়েছিল এই দম্পতি। নিপা তখনই বুঝতে পারে তার কোলজুড়ে সন্তান আসবে। এ খবরটা তাদের কাছে যতোটা না আনন্দের; তার চেয়ে বেশি দুর্ভাবনার। মা হওয়া; কিন্তু সন্তান ধারণের শারীরিক সক্ষমতা আছে কি না তাও এ কিশোরীর জানা নেই। যেন নিজের অজান্তেই শরীরে সন্তান ধারণের শারীরিক অনুভূতি এখন নিপার কাছে ভাবনার। ভাবনায় ফেলেছে স্বামী ইলিয়াসকেও। কারণ দু’জনের কেউই এজন্য প্রস্তুত নয়।
গর্ভে সন্তান আসার বিষয়টি বুঝতে পেরেছে কি-না? গল্পের ছলেই নিপা জানালো, ‘মুই বুজমু ক্যামনে। মাস তিনেক আগে বমি আইছে কয়দিন। হ্যারপর আর কিচ্ছু বুঝি নাই। ডাক্তারের ধারে যাইয়া বুইজ্যা গ্যাছি। বয়স তিন-চাইর মাস অইতে পারে’। লজ্জায় নিচু মুখে বুড়ো আঙুলে মাটি ঘঁষে চলে নিপা।
গর্ভবতীদের সেবা-পরিচর্যায় সরকারের সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সেসব এই কিশোর-কিশোরী দম্পতির ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বাস্থ্যকর্মী বলতে কাউকে এরা চেনে না। জানে না তাদের কী কর্মকান্ড। এমন কারও পদচারনা তারা কখনও বাড়ি চারপাশে দেখেন নি। অথচ সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীণ ভাতা দেয়ার কার্যক্রম চালু রয়েছে। রয়েছে মাতৃস্বাস্থ্য সেবা ভাউচার স্কীমের সরকারি সহায়তা। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিংবা এসময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও এদেও কিছুই জানা নেই। আর জানলেও কী-ই বা করার আছে; তিনবেলা পেটভরে খাবারের সঙ্গতি যেখানে নেই, সেখানে পুষ্টিকর খাবারের চিন্তা করতে কীভাবে?
অথচ, কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মো. গোলাম ফরহাদ জানালেন, এসময় এ মায়ের স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার বেশি প্রয়োজন। মাছ মাংস খাওয়া জরুরি। এছাড়া প্রথমেই আলট্রাসনোগ্রাফি করে গর্ভের সন্তানের বয়স নির্ধারণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। কারণ একে তো কিশোরী বয়সে নিজেই মা হয়ে যাচ্ছে, তার ঝুঁকিও বেশি থাকছে। কিন্তু এসব কীভাবে মেটাবে এ দম্পতি। এদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় প্রতিদিন।
এ অবস্থায় শুধুই হতাশা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে না জানা গন্তব্যে এগিয়ে চলছে এ দম্পতি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে এই দম্পতি চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। মাতৃত্বের ঝুঁকি সামলানো থেকে শুরু করে জীবনের কোন সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা নেই তাদের। এই দম্পতির কাছে এখন শুধুমাত্র চিকিৎসা সমস্যাটি প্রধান সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত।
নিপার শ্বশুর রফেজ খান জানান, দাদার আমলে এই গ্রামে বসবাস করছি। ভাইয়েরা ভাগাভাগি করতে করতে এখন আমার বাড়িঘরের জায়গা ছাড়া চাষের কোন জমি নেই। ঘর-দুয়ার বিয়ে দেয়া মেয়েরা ঠিক করে দিয়েছে। নইলে আকাশের নিচে থাকতে হতো। তিনি আরও জানান, নিজের স্ত্রী রোগে শয্যাশায়ী অর্থাভাবে চিকিৎসা চলে না। বয়সের ভারে নিজের কাজ-কর্ম নেই। এলাকার জনপ্রতিনিধির ওপর এই মানুষটির প্রচন্ড ক্ষোভ। কারণ কোনো ধরনের সহায়তা তাদের ভাগ্যে জোটেনি কখনো।
[ পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: ri_montu@yahoo.com ]
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৫
আরআইএম/এমজেএফ