ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারা বেলা কথা কয়,
---
কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
---
দু কদম হেঁটে এস মোদের কুটির,
পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
খুলনার দাকোপ থেকে বটিয়াহাটার পথে পশুর নদীর সঙ্গে সমান্তরাল বয়ে যাওয়া পাকাসড়কের পাশে শিমুলতলা গ্রামে বৃদ্ধ নূরে আলী হাওলাদারের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের এই ‘কুটির’ কবিতাটি মনে পড়ে যাবে। সব মিলে যায়, কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন। তাতে নূরে আলী হাওলাদারের নাতি-নাতনিরা খেলা করছে। শুধু একটাই অমিল। নূরে আলীর বাড়িতে এখন আর পিলসুজে মিটির মিটির বাতি জ্বলে না, সেখানে জ্বলে বৈদ্যুতিক আলো। সে-আলো আসে সৌরশক্তি থেকে।
সড়ক থেকে দু’কদম হেঁটে গিয়ে পাতার কুটিরের চালে চোখে পড়বে সাদা সোলার প্যানেল। সূর্যের করা রোদ তাতে পড়ে ভেতরে শক্তি দিচ্ছে আর বাইরে থেকে পাতার কুটিরকে দিচ্ছে এক ভিন্ন রূপ। এই সোলারের আলোয় পাশাপাশি দুটি কুটিরে তিনটি বাল্ব জ্বলে। সেই আলোতে পড়ালেখা চলে নূরে আলী ও সরবানুর নাতি-নাতনিদের।
সে এক দারুণ দৃশ্য। শিয়ালডাঙ্গা থেকে এসে কুড়ি বছর আগে এই নদীর ধারে বাড়ি করেছেন নূরে আলী। এতদিন এই বাড়িতে তেলের কুপিই আলো দিতো। কিন্তু বছর খানেক আগে থেকে বাড়িতে জ্বলছে সৌরশক্তির বিদ্যুৎ। নূরে আলীর নিজের ক্ষমতা নেই, তবে তার এক মেয়ে খুলনার এনজিও থেকে কিস্তিতে নিয়ে বাবা-মাকে উপহার দিয়েছেন এই সৌরপ্যানেল। ১০০ ওয়াটের ছোট্ট দুইফুট বাই দেড়ফুট আকারের এই প্যানেল থেকে আলো যায় পাশাপাশি দুটি ঘরে। তাতে নূরে আলী তিন ছেলে, ছেলে বৌ ও নাতি-পুতিদের নিয়ে বাস করেন।
কেরসিনের দামে কূলোতে পারছিলেন না, আর সে কারণেই এই সোলার প্যানেল, জানালেন নূরে আলী।
‘কেরাসিনের দাম ম্যালা। আর সকলে লাগায়, আমরাও লাগাইলাম। আমার সামর্থ হয় নাই, আমার মাইয়ায় নিয়া আইছে। ’
একটি প্যানেলের দাম পড়েছে ১৪ হাজার টাকা। এতে দুই ঘরে তিনটি বাল্ব জ্বলে। অপেক্ষাকৃত বড় কুঁড়েঘরে দুটি, অপরটিতে একটি বাল্ব দেওয়া হয়েছে।
আলো মন্দ হয় না, বলেন নূরে আলী। কাজ চলে, নাতি-পুতিরা লেখা-পড়া করতে পারে। আমরাতো আর ম্যালা সময় জ্বালাই না, সন্ধ্যায় একটু লেখা পড়া, খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত চলে।
আগে ২০০ গ্রাম কেরসিন এনে অনেক মিতব্যয়ী হয়ে সর্বোচ্চ দুই দিন চালাতে পারতেন নূরে আলীরা। তাতে প্রতি দুই দিনে ১৫ টাকার তেল লাগতো। মাসে খরচ পড়তো ২২৫ টাকা। তাতে সামান্য আলোই জ্বলতো নূরে আলীর বাড়িতে। এখন কেরোসিনের কোনও খরচ নেই।
সরবানু ওদিক থেকে স্বামীকে স্মরণ করিয়ে দেন এখন কেরসিনের খরচ নেই, তবে কিস্তিতে কেনা সোলার প্যানেলের দাম শোধ করতে হয়। মাসে কিস্তি ৩৫০ টাকা। সেটাকা অবশ্য নূরে আলীকে নয় দিতে হচ্ছে তার মেয়েকে। বাবা-মায়ের জন্য এনজিও থেকে কিস্তিতে এই প্যানেলটি কিনে দিয়েছেন তিনি। সেটাকাও শোধ হয়ে যাচ্ছে। ৪০ মাসের কিস্তি, আর মোটে কয়েক মাস বাকি আছে। এরপর নূরে আলীর বাড়িতে আলো জ্বলতে আর খরচ বলতে কিছু থাকবে না।
কুটিরের ভেতরে ঢূকে সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দেখালেন সরবানু। আবারও বললেন, ‘মাইয়াডা সমিতি কইরা একটা লাইট কিইনা দিছে, তাই দিয়া আমরা আলো পাইতেছি। ’
কেবল নূরে আলীর নয়, পাশেই টিনের দোচালা ঘর শাহীনূরদের। তার বাড়িতেও একটি সোলার প্যানেল। অপেক্ষাকৃত বড়। এটিতে ঘরে তিনটি বাল্ব একটি ফ্যান চলে। আরও এগিয়ে দেখা গেলো ও জানা গেলো এই সড়কের দুই ধারে শিমুল তলা, গোড়াতলা, ফুলতলা, হাতিয়াডাঙ্গা, খোড়ে, গোপালখালী, বালুখালি, নাড়িতলা, খইয়া তলা, গাঁওগড়া নামের গ্রামগুলোতে প্রতিটি বাড়িতে এমন সোলার প্যানেলের ব্যবহার। এতে কেরসিনের খরচ বেঁচেছে। তবে সবচেয়ে যেটা অগ্রগতি তা হচ্ছে গ্রামগুলোতে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার সুযোগ বাড়ছে। রাতে কেরসিন ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকতে হয় না।
ফুলতলা গ্রামে দেখা গেলো একটি স-মিলের চালে সোলার প্যানেল। ডিজেল চালিত জেনারেটরে চলে করাত, আর আশেপাশে আলো জ্বলে সোলারে। বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকলেও এই পদ্ধতিতে ফুলতলা গ্রামে সচল কাঠকাটার অর্থনীতি। সেখানেও সোলারের অবদান।
এ বিষয়ে বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহবুবুর রহমান মুন্নার কথা হয় খুলনায় সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহকারী বেসরকারি সংস্থা চলন্তিকা যুব সোসাইটির সঙ্গে। সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মিল্টনের তথ্য মতে, আকার ও প্রকারভেদে ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার ৫শ টাকা পর্যন্ত একেকটি সোলার প্যানেলের দাম।
কেবল খুলনাতেই নয় ওই অঞ্চলের বরিশাল, শরিয়তপুরসহ আশ-পাশের বিভিন্ন জেলায় সহজ শর্তে সোলার প্যানেল সরবরাহ করে চলন্তিকা যুব সোসাইটি।
গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে যাওয়া এসব সোলার প্যানেল চীন থেকে আমদানি করা হয়। তবে এখন দেশেও এটা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া এলইডি অ্যাসেম্বলিং, চার্জ কন্ট্রোলার তৈরির মতো কাজ করতে সমর্থ হওয়ায় দেশের মানুষ এখন কম খরচে সৌরশক্তি ব্যবহার করতে পারছে।
মিজানুর জানান, ২০১৫ সালে চলন্তিকা থেকে সাড়ে ৫ হাজার সোলার প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগের গ্রাহকই কৃষক ও স্বল্প আয়ের মানুষ।
এতো কেবল চলন্তিকার হিসাব। দেশে কয়েক ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সোলার প্যানেল সরবরাহ করছে। তাতে প্রতি মাসে গড়ে লক্ষাধিক সোলার প্যানেল বিক্রি হয়। ২০১৪ সালে যা ছিলো মাসে ৮০ হাজার, তার দুই বছর আগে এর সংখ্যা ছিলো ৪০ হাজারের নিচে।
এতেই বোঝা যায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
ভিশন টোয়েন্টি-টোয়েন্টিওয়ানের আওতায় সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি নাগরিকের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সালের মধ্যে সৌর শক্তি থেকে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা দিয়ে ৬০ লাখ মানুষের ঘরে আলো নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে।
২০১৫ সালের শেষ নাগাদ সারা দেশে প্রায় ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে৷ ধারনা করা হচ্ছে, আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি বাড়িতে সৌরশক্তি পৌঁছে যাবে৷ যারা এখনো বিদ্যুৎ বঞ্চিত তাদের ঘরেও পৌঁছাবে বিদ্যুতের আলো।
নূরে আলীর কুটিরের চালে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল এই লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে চলার পথে এক জ্বলজ্বলে সাক্ষী।
বাংলাদেশ সময় ১০২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৫
এমএমকে