ঢাকা, সোমবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ মে ২০২৪, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের শিশু-০২

শিশু বয়সেই বৈঠা হাতে নদীর জলে

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৬
শিশু বয়সেই বৈঠা হাতে নদীর জলে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

[কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনোবা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন।

শিক্ষা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই শুরু হয় বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কন্যা শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার এই চিত্র তুলে এনেছে বাংলানিউজ। বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদারের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব। ]

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: উপকূল জুড়ে শিশু শ্রমের এক মহাযজ্ঞ। আর এর অধিকাংশই জড়িত মৎস্য শিকার ও জেলে পেশায়। বাড়তি উপার্জনের জন্য অভিবাকরা স্কুলগামী শিশুকে পাঠিয়ে দেয় মাছ শিকারে। এদের অনেকে আবার বড়দের সঙ্গে সাগরে যেতে যেতে হয়ে উঠে দক্ষ জেলে। তবে এর মূল কারণ হিসেবে অভাব এবং অশিক্ষাকে দায়ী করছেন সচেতন মহল।

যে হাতে থাকার কথা বই খাতা, সেই হাতে শক্ত বৈঠা। কঠিন বাস্তবতার শিকার হয়ে বরগুনার অধিকাংশ শিশু লেখা-পড়া থেকে ঝরে পড়ছে। চরাঞ্চলের অসংখ্য শিশু স্কুলে না গিয়ে ঝুঁকে পড়ছে রোজগারের দিকে। উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় বেশির ভাগই জড়িয়ে পড়ছে জেলে পেশায়।

বরগুনা সদর উপজেলার বড়ইতলা গ্রামের বিষখালী নদী তীরের শাওন (১৩)। বৈঠা হাতে নৌকা আর জাল নিয়ে ছুটছেন মাছ শিকারে। কথা বলা কিংবা শোনার ফুসরত নেই তার, জোয়ার এসেছে এখনি ছুটতে হবে নদীর বুকে। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পারলেও অভাবের কারণে আর বেশি দূর এগুতে পারেনি শাওন। জীবন-জীবিকার তাগিদে বাবার সঙ্গে নামতে হয়েছে মৎস্য শিকারে। তবে এখন আর বাবাকে প্রয়োজন হয়না। সে নিজেই একজন দক্ষ মাঝি ও দক্ষ জেলে। যেমনি ভালো নৌকায় চালায়, তেমনি মাছ শিকারে হাত পাকিয়েছে বড়দের মতো।

শাওন বাংলানিউজকে বলেন, পড়তে মোন চায়, কিন্তু অভাব তো পিছু ছাড়ে না। পড়া লেহা মোগো জন্য না,  বড়লোকের পোলাপাইনের জন্য। মোগো জন্মই কাম করে খাওয়ার লাইগ্গা।

এখানেই নৌকা আর জাল নিয়ে নদীতে যেতে দেখা যায় ফয়সাল (১২) নামে আরেক শিশুকে। তারও উদ্দেশ্য নদীতে মাছ শিকার। মাছ শিকার করে পাশেই বড়ইতলা খেয়াঘাটে বিক্রি করবেন তারা।

ফয়সাল বাংলানিউজকে জানায়, মাছ না ধরলে খামু কি? মাছ ধরতে আইলেই তো দু’চারটা ভালো মন্দ খেতে পারি। আমার বয়সী সবাই যখন স্কুলে যায়, আমি তখন গাঙ্গে যাই। আমারো মন চায় স্কুলে যাই, কিন্তু ঐ যে অভাব পিছু ছাড়ে না। পেটে ভাত না থাকলে স্কুলে গিয়ে কি হবে?

এখানেই কথা হয় বাবুল (১৪) নামে আরেক শিশু জেলের সঙ্গে। প্রায় ৬ বছর ধরে জেলে পেশায় নিয়োজিত রেখেছে নিজেকে। বাবা মা ও ছোট একটি বোন নিয়ে তাদের সংসার। বাবাও পথ অনুসরণ করে সে নিজেও একজন জেলে। বাবা-ছেলের আয়ে চলে তাদের সংসার। তবে তার বাবার বয়স একটু বেশি হওয়ায় এখন আর গভীর সমুদ্রে যেতে পারেন না। কিন্তু প্রতি মৌসুমে বাবুল ছোটেন গভীর সমুদ্রে।

বাবুল বাংলানিউজকে বলেন, নিজে শিক্ষিত হইতে পারি নাই, হেতে কি হইছে, ছোট বোনটারে শিক্ষিত বানামু। ও যতদূর পড়তে চাইবো অরে ততদূর পড়ামু, তাতে আমাদের যত কষ্টই হোক। শিক্ষিত হওয়ার কি মূল্য এহন মুই বুঝি, আর এই ভুল করবো না।

বরগুনা সদর উপজেলার শুধু শাওন, ফয়সাল ও বাবুলই নয় নদী তীরে অবস্থিত লতাকাটা, বাইনসমের্ত, বালিয়াতলী গ্রামেও একই দৃশ্য চোখে পড়ে। উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটা, তালতলীতেও এ চিত্র ভয়াবহ। এখানকার অসংখ্য শিশু শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ছে অকালে। তবে শিশুদের এভাবে ঝরে পড়া ও কঠিন কর্মযজ্ঞে নামার পেছনে অভিবাবকরা দায়ী করছেন দারিদ্রকে।

বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া গ্রামের এক জেলে অভিবাবক আনোয়ার বাংলানিউজকে জানান, জেলে পেশায় যারা নিয়োজিত তারা বিভিন্ন সময় দস্যু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে যায়, তখন বাধ্য হয়ে আদরের সন্তানকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ এ পেশায় পাঠাতে বাধ্য হয়। পরিবারকে দেনা দায় থেকে বাঁচতেই শিশুরাও নেমে পড়েন মৎস্য শিকারে।

বরগুনা জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি আবু হেনা ইমরুল কায়েস বাংলানিউজকে বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে অভাবই শিশু শ্রমের মূল কারণ। এছাড়াও শিক্ষার একটি বড় প্রভাব রয়েছে এই শিশু শ্রমের উপরে। কেননা এখানকার মানুষ অতটা শিক্ষিত নয়, তাই প্রতিনিয়ত এ শিশু শ্রম বেড়ে চলছে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের নলী মৎস্য বন্দরে অনেক শিশু আছে যাদের এখন স্কুলে থাকার কথা। কিন্তু তা না গিয়ে এখানে কাজ করছে পুরোদমে। আর এর মূল কারণ হচ্ছে অভাব ও অস্বচ্ছলতা। উপকূলীয় অঞ্চলের এ দরিদ্র জেলে পরিবারগুলোকে স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা হলে যেমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে আসবে, তেমনি এসব অঞ্চলের শিশু শ্রমের হারও কমবে। সেই সঙ্গে বাড়বে শিক্ষিতের হার।

বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান ঝন্টু বাংলানিউজকে বলেন, উপকূলীয় শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারলেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী দেশের স্বপ্ন দেখতে পারবে।

তিনি আরো বলেন, এসব শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে তাদের পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে সবার আগে, তবেই উপকূলীয় চরাঞ্চলের শিশুদের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব।

** উপকূলে অপ্রতিরোধ্য শিশু শ্রম (পর্ব-১)

বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৬
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।