ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

‘প্যাড বাঁচাইতে বাঁচাইতে শ্যাষ, পিঠও বাঁচবো না’

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৬
‘প্যাড বাঁচাইতে বাঁচাইতে শ্যাষ, পিঠও বাঁচবো না’

পাথরঘাটা (বরগুনা থেকে): সিডর বিধ্বস্ত বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানি গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মো. ইসমাইল হাওলাদার এখন আর তেমন একটা মাছ ধরতে যান না। বাড়ির পাশের খাল পার হয়ে বলেশ্বর নদের অল্প দূরত্বে গিয়ে যদি কখনও যেতে পারেন, মাছ মেলে সামান্য, বেশিরভাগ সময় মেলেই না।

অথচ এই ইসমাইলই এক সময় খরস্রোতা বলেশ্বর পাড়ি দিয়ে গভীর সুন্দরবনের সুবতি রেঞ্জে গিয়ে আড়াই থেকে পাঁচ কেজি ওজনের কাওন মাছ ধরেছেন ১০/১২ হাত পানির নিচ থেকে। ১০ বছর আগেও নদী-খালের কিনার-কূল থেকেই একবারে পেয়েছেন এক-দেড় পন (৮০টিতে পন) ইলিশও। আর এখন নদী-সাগরের অনেক গভীরেও মেলে না আট/দশটিও।

কারণ, সরকার নিষিদ্ধ-অবৈধ নেট জাল-কারেন্ট জাল-বাদা জাল (স্থানীয় ভাষায় চর ঘেরা) নষ্ট করছে ডিম-পোনা, ধ্বংস ডেকে আনছে মাছের। বিশেষ করে বাচ্চা থেকে চাবলি, চাবলি থেকে জাটকা আর ছয় মাস বয়সে ডিম পেরে প্রজনন, বংশবিস্তার- ইলিশের এই জীবনচক্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষতিকর জালগুলোতে জাটকা নিধনে।

উপকূলের দুর্গম প্রত্যন্ত এই জনপদের ৬৬ বছরের বৃদ্ধ ইসমাইলের ভাষায়, ‘বছরের পর বছর আট আনিই (অর্ধেক) থাহে না, ধ্বংস হইয়্যা যায় অবৈধ জালে’।

সরেজমিনে গত দু’দিনে দেখা গেছে, ভয়াল সিডর বিধ্বস্ত পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা, চরলাঠিমারার জিনতলা, পদ্মা, তাফালবাড়িয়া, কালমেঘা, কাকচিড়া, কাঁঠালতলীর পড়িঘাটা, চরদুয়ানি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানি, জ্ঞানপাড়া গ্রামসহ উপজেলার সব জেলেরাই চলতি বর্ষা মৌসুমে মাছ সংগ্রহ যজ্ঞে মেতেছেন। বঙ্গোপসাগরের উপকূল এবং বলেশ্বর-বিষখালী নদী বা বেশ কয়েকটি খালের তীরবর্তী উপজেলার ১১৭ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধের ওপরে ও পাশে বসবাসকারী জেলেদের বেশিরভাগই চলতি বর্ষা মৌসুমে সাগর-নদীতে মাছ ধরতে চলে গেছেন, কেউ কেউ দু’একদিনের মধ্যেই যাবেন।

নিয়ত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগর, বিষখালী-বলেশ্বরে ডুবে মরার ভয়-আতঙ্ককে পেছনে ফেলে তারা নতুন আশা-স্বপ্নে বুক বেঁধেছেন। সিডরের ক্ষতি পুষিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়ও তাদের চোখে-মুখে।

ছোট-বড় নৌকা-ট্রলার আর জাল তৈরি-মেরামত-সংস্কার করে পানিতে নামতে প্রস্তুত হচ্ছেন চরদুয়ানির বিশ্বাস বাড়ির মাঝি-মালিক মো. বাদল (৩৫), মো. দুলাল (২৫), জেলে জাফর জমাদ্দার (৩৯) ও তার ছেলে ১৫ বছরের কিশোর রেজাউলরাও। আড়তদার মজিবর বিশ্বাস তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। এইসব সংগ্রামী মানুষগুলোও জানেন-স্বীকার করেন, অবৈধ এসব নেট জাল-কারেন্ট জাল-বাদা জাল (স্থানীয় ভাষায় চর ঘেরা) মাছের ধ্বংস ডেকে আনছে।

তাদের জীবন সংগ্রাম-বেঁচে থাকার মূল সম্পদও মাছ। অথচ জেনে-শুনেই মৎস্যজীবী সম্প্রদায় এসব ব্যবহার করছে অনেকটা প্রকাশ্যেই।

গ্রামটির ঘরের বেড়া, মেঠো রাস্তার পাশে, খেতে-মাঠে শুকাতে দেখা গেছে নেট জালও। উদ্দেশ্য, ডিম-পোনা-জাটকা-মা ইলিশ নিধনের জন্য প্রস্তুত করা।

ইসমাইল হাওলাদার বলছিলেন- ‘কূলে আইসা হাজার হাজার পোনা মাছ ধরা পইড়্যা যায় ওইসব জালে। ডিম ছাড়বো কি কইর্যা? বড় অইবো কি কইর্যা? কোটি কোটি ডিম ধইর্যা ফেইল্যা দেয়, নষ্ট করে। সারা দ্যাশের মানুষ মাছ খাইতে পারবো না এক সময় ওই জালগুলো বন্ধ না হরলে’।

কেন এ আত্মঘাতী কাজ?- ইসমাইল হাওলাদারের জবাব, ‘কি করবো? বউ-পোলাপাইন, বাচ্চা-কাচ্চা, গুড়া-গাড়া লইয়্যা প্যাড তো বাঁচাইতে অইবো। পুঁজি খাটাইয়া মাছ পায় না। চালান তো টেকাইতে অইবো, লোনের টাহা শোধ দিতে অইবো। তহনকার প্রয়োজনে এইসব করে। কিন্তু সব সময়ের জন্যি ক্ষতি কইর্যা ফ্যালে’।

‘প্যাড বাঁচাইতে বাঁচাইতে শ্যাষ, পিঠও বাঁচবো না। ’।

নিজের ঘরেরই খাটে থাকা নেট জাল দেখিয়ে এই বৃদ্ধ খেদের সঙ্গেই বললেন- ‘সরকারের লোকেরাই (ফরেস্টার-কোস্টগার্ড-নৌপুলিশ-র্যাব) ট্যাহা খাইয়্যা এ সুযোগ কইর্যা দেয়। বাদা-নেট বন্ধ কইর্যা দেন। দ্যাখবেন, দ্যাশ আবার মাছে-মাছে ভইর্যা যাইবো’।

পদ্মা গ্রামের রহমান খাঁ (২৭), রহিম মুন্সী (৩৩) এবং জাহাঙ্গীর (২৮), খলিফার বাজারের রহিম মুন্সি (৫৬), মো. জালাল (২৪), আব্বাসরাও (২৫) প্রস্তুত পানিতে নামতে। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বলেশ্বর নদের কচিখালী পয়েন্ট, বঙ্গোপসাগর-বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরের মোহনা এবং আশপাশের খালগুলোতে মাছ ধরবেন তারা। তবে বৈধ ও ক্ষতিকর নয় এমন সুতার জালই ব্যবহার করছেন।

তাদেরও কষ্ট- ‘আমাগো ভাসা জাল। ধরা জাল, খুটা জাল, নেট জাল নেয় অন্যরা, গ্রাফি দিয়ে জাল বাধে ওরা। আর আমরা কষ্টে থাহি মাছ কম পাইয়্যা’।

বাংলাদেশ সময়: ০১৪২ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৬
এএসআর/এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।