ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

পান থেকে চুন খসলেও মার খেতে হয় নারীকে

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৬
পান থেকে চুন খসলেও মার খেতে হয় নারীকে ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গাবুরা (শ্যামনগর), সাতক্ষীরা থেকে: বাড়ির উঠানে বাসন পড়ে আছে। কোনো শিশু সেখানে খেলতে গিয়ে ফেলে রেখেছে।

স্বামীর কাছে এ জন্যেও মার খেতে হচ্ছে রোকসানাকে। তার দোষ, কেন বাসনটি এখানে পড়ে আছে? উপকূলীয় এ দ্বীপে পান থেকে চুন খসলেও মার খেতে হয় নারীকে। অনেক সময় নিছক মনের শখ পূরণ করতেও স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন স্বামীরা। আবার অনেক পুরুষের স্ত্রীকে মারাটাই অভ্যাস।
 
মঙ্গলবার (২৮ জুন) সকালে গাবুরা ইউনিয়নে নারীদের সঙ্গে কথা বলে এ নির্মম অত্যাচারের চিত্র পাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মার খাওয়ার ব্যাপারে তারা নিজেরা মুখ খোলেননি। বরং প্রতিবেশীরাই বিষয়টি জানিয়েছেন বেশি।

খোলিসাবুনিয়ার মাসুদুল হক (ছদ্মনাম) নদী থেকে ফিরলেই স্ত্রীকে মারধর করে বলে জানান প্রতিবেশীরা।

খোলিসাবুনিয়ার বাসিন্দা রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, মাসুদ প্রতিদিনই তার বউকে অমানুষিকভাবে মারেন। আমাদের ভয় লাগে কবে এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারাই যায় মেয়েটি। কোনো কারণ ছাড়াই মারে মাসুদুল। বউ কথা বললেও মারে, না বললেও মারে। হাঁটলেও মারে, বসে থাকলেও মারে।

তিনি আর বলেন, আমাদের এখানে শিক্ষিতের হার খুবই কম। আর বন ও নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মানুষের মধ্যে মায়া মমতাও অনেক কম। অনেক সময় স্ত্রীকে মারাটাও শখ।
 
বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের কমিউনিটি উঠান বৈঠক চলছিল মঙ্গলবার (২৮ জুন) দুপুরে। সেখানে নারীদের সঙ্গে কথা বললে, সবাই পুরুষদের পৈশাচিক মারের কথা বলেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে শাশুড়িরাও বউদের ওপর নির্যাতন করেন বলে তারা জানায়।
 
মধ্য খোলিসাবুনিয়ার আঞ্জুমান আরা বাংলানিউজকে বলেন, এখানে নারীরাও পুরুষদের মতোই মাছ ধরার কাজ করেন। চিংড়ির ঘেরে কাজ করেন। তবে বনে নারীরা এখন আর জান না। এসব কিছুর পরেও সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া করাতে হয়। অথচ স্বামীরা সেসব বুঝতেই চান না। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলেন। ভাত সেদ্ধ হওয়ার পর একটু নরম বা শক্ত হলেও মার খেতে হয় স্ত্রীদের।
 
এ বৈঠকের সব নারীই অভিযোগ করে বলেন, দ্বীপের পুরুষেরা নারীদের গায়ে হাত তোলেন। বর্ষাকালে পুরুষরা ঘরের বাইরে বেশি থাকেন। ফলে এ সময় মার খেতে হয় কম। গ্রীষ্মের সময়ই স্বামীদের মারার প্রবণতা বাড়ে। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউই তার গায়ে স্বামীর হাত তোলার বিষয়টি স্বীকার করেননি।
 
একই গ্রামের শাহানা আক্তার বলেন, স্বামীদের হাতে মার খেলেও এখানেই পড়ে থাকতে হয়। বাপের বাড়িতে যাবো? জায়গা দেবে না। আর পুলিশের কাছে গেলে তো, স্বামীও আর ঘরে তুলবে না, তাই এখানেই পড়ে থাকতে হয়। তাদের শখ তারা মেরে আনন্দ পায়।

রেজাউল করিম বলেন, অনেক সময় স্বামীরা স্ত্রীদের ত্যাগ করতে চান। তখন সাধারণত সালিশির মধ্য দিয়েই এসবের সমাধান করা হয়। স্ত্রীরা অভিযোগ করেন না, যদি বাবার বাড়ি সহযোগিতা না করে।
 
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে শ্যামনগর উপজেলার ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেলের প্রোগ্রাম অফিসার প্রণব বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, এখানে বেশিরভাগ সময়ই মেয়েরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অভিযোগ নিয়ে আসেন। তারা চাইলে, আমরা পুলিশের কাছে মামলার জন্য আবেদন জানাই ও আইনি সহায়তা দেই।

উপকূলীয় দ্বীপ থেকে তাদের সেন্টারে অভিযোগ নিয়ে আসা নারীদের সংখ্যা কম। কৈখালী, বুড়িগোয়ালীনি থেকে কিছু অভিযোগ রয়েছে। শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে।

নিরক্ষরতা, দারিদ্রতা, শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা, অবসর সময়ের কারণেই স্ত্রীদের ওপর পুরুষদের নির্যাতনের হার অনেক বেশি বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৮ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৬
এমএন/এএটি/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।