ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

সাতক্ষীরা উপকূলের অর্ধ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত, জোয়ার নিয়ে শঙ্কা  

শেখ তানজির আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৩ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০২১
সাতক্ষীরা উপকূলের অর্ধ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত, জোয়ার নিয়ে শঙ্কা  

সাতক্ষীরা: একটি জোয়ার কোনো মতে মোকাবিলা করতে পারলে চিন্তা শুরু হয় পরের জোয়ার নিয়ে। অমাবস্যা, পূর্ণিমা কি ঘূর্ণিঝড়- সব সময়ই উপকূলের মানুষের চিন্তা জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে।

এই বুঝি সব ভেসে গেল- এমন আতঙ্কে রাত কাটে সাতক্ষীরা উপকূলের বাসিন্দাদের।

এবার পরিস্থিতি যেন আরও ভয়ানক। নদীতে ভরা পূর্ণিমার জোয়ার, অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব। মঙ্গলবার থেকেই তাই উপকূলের মানুষ এক জোয়ার যায়, আরেক জোয়ার আসে- এমন চিন্তায় পার করছেন সময়।

মঙ্গলবার তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও বুধবার (২৬ মে) শেষ রক্ষা হয়নি সাতক্ষীরা উপকূলের বাসিন্দাদের।  

ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াসে’র প্রভাবে সৃষ্ট উচ্চ জোয়ারে উপকূলবর্তী শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরাসহ কৈখালী ইউনিয়ন সম্পূর্ণরূপে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ভাঙন কবলিত বুড়িগোয়ালীনি, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ, কাশিমাড়ী ও রমজাননগর ইউনিয়নের আরও অর্ধ শতাধিক গ্রামে জোয়ারের পানি ঢুকেছে।  

এসব এলাকার পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি তাৎক্ষণিকভাবে পানিতে নিমজ্জিত হওয়া ছাড়াও হাজার হাজার একর জমির চিংড়ি ঘের ও মিষ্টি পানির পুকুর জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। অর্ধলক্ষাধিক মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে পানিবন্দি হয়ে পড়ার পাশাপাশি উপদ্রুত এলাকায় খাদ্যদ্রব্যসহ পানযোগ্য পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

বুধবার (২৬ মে) বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকায় জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করে, তা উপকূলবর্তী শ্যামনগর উপজেলার ৭০টিরও বেশি গ্রাম ভাসিয়ে নেয়।

এদিকে, দুপুরে ভাটা শুরু হওয়ার পরও নদীতে সেভাবে পানির টান না থাকায় রাতের জোয়ার নিয়ে প্লাবিত এ জনপদের মানুষের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আগে থেকে সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে আশ্রয় না নেওয়ায় প্লাবিত হওয়ার পর চারপাশে পানিবেষ্টিত মানুষজন উদ্ধারকর্মীদের সহায়তার জন্য অপেক্ষা করছেন।

জানা গেছে, বুধবার সকাল থেকে আগের দিনের ভীতিকে বাড়িয়ে নদ-নদীতে পানি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে অতি জোয়ারের চাপে শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা ৫, ১৫ ও ৭ নং পোল্ডারের বিভিন্ন অংশে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। শুরুতে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার নাপিতকালী, জেলেখালী, গাগড়ামারী, চাঁদনীমুখা এলাকার বাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এসময় প্রায় চার শতাধিক গ্রামবাসী একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁধের ওপর আইল দিয়ে পানির প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রবল জোয়ারের তোড়ে সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এসব অংশ দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে সুন্দরবনের কোলে গড়ে ওঠা চারপাশে নদীবেষ্টিত দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার ১৫টি গ্রামের সবগুলো প্লাবিত হয়।

প্রায় একই সময়ে সীমান্তবর্তী কালিন্দি নদী সংলগ্ন নীদয়া অংশের বাঁধ ভেঙে ও পার্শ্ববর্তী একাধিক অংশে বাঁধ উপচে মাদার নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলে দুপুরের মধ্যে কৈখালী ইউনিয়নের ২২টি গ্রামের সবগুলো প্লাবিত হয়।

এর আগে সুন্দরবনের মধ্যে গড়ে ওঠা একমাত্র জনবসতি রমজাননগর ইউনিয়নের গোলাখালী গ্রামের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সেখানকার ৮৮টি পরিবারের সবার ঘরবাড়ি ও অর্ধশত চিংড়ি ঘের সাগরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। গ্রামবাসী তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের নৌকায় আশ্রয় নিলেও তাদের বসতঘর ও ব্যবহার উপযোগী সব কিছু সাগরের পানিতে ভেসে যায় বলে জানান আইমান বেগম ও আসলাম হোসেনসহ স্থানীয়রা।

মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহড়তলী এলাকার উপকূল রক্ষা বাঁধের প্রায় এক ফুট ওপর দিয়ে পাশের চুনকুড়ি নদীর পানি তীব্র বেগে লোকালয়ে প্রবেশ করলে পাশের তিনটি গ্রাম তাৎক্ষণিকভাবে পানিতে তলিয়ে যায়। এসময় আটকে পড়া স্থানীয়দের উদ্ধার করতে যেয়ে আব্দুস সামাদ নামের এক সিপিপির স্বেচ্ছাসেবী স্রোতের টানে ভেসে যেয়ে আহত হন।

বুড়িগোয়ালীনি ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল জানান, দুর্গাবাটি, মাদিয়া, ভামিয়া, পোড়াকাটলা ও দাতিনাখালীসহ পানখালী এলাকার বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় ছয়টি গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাঁধের ওপর দিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশের সুযোগে পশ্চিম দুর্গাবাটি এলাকার উপকূল রক্ষা বাঁধের অন্তত ৩০ মিটার ভেঙে গেছে বলে জানান নিলুৎপল মণ্ডলসহ স্থানীয় কয়েকজন।

এদিকে, পদ্মপুকুরের পাতাখালী বাজার সংলগ্ন উপকূল রক্ষা বাঁধের তিনটি পয়েন্টে ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার বাঁধের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পশ্চিম পাতাখালী ও ঝাপাসহ তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুপুরের জোয়ারের পর সৃষ্ট ভাটার সময়ে নদীতে তেমনভাবে পানির টান না থাকায় রাতের জোয়ারে নতুন নতুন এলাকাসহ ইউনিয়নের সিংহভাগ প্লাবিত হতে পারে বলে জানান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান।

এদিকে, উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনায় বেলা ২টার দিকে জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল শ্যামনগরে পৌঁছে উপজেলা প্রশাসনসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে জরুরি সভা করেছেন।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপকূলবর্তী এ জনপদকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৮ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০২১
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।