ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

বসতবাড়ির অর্ধেক মেঘনায়, বাকিটা বিলীনের অপেক্ষায় 

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৪ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২২
বসতবাড়ির অর্ধেক মেঘনায়, বাকিটা বিলীনের অপেক্ষায়  ভাঙন হুমকিতে বসতবাড়ি। ছবি: বাংলানিউজ

মেঘনা নদীর উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। নদী এ অঞ্চলের মানুষের জন্য যেমন আর্শিবাদ, তেমনি অভিশাপও।

নদী অনেক মানুষকে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করে দিয়েছে, আবার অনেককে সর্বশান্তও করে দিচ্ছে। নদীকেন্দ্রীক বাসিন্দাদের দুঃখ-দুর্দশা এবং জীবনচিত্র নিয়ে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদন।  

পর্ব-০১

 
লক্ষ্মীপুর:
মেঘনার উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দা দুলাল হোসেন। জন্মের পর থেকে যে বাড়িতে তিনি বসবাস করতেন, তার বেশিরভাগ অংশ মেঘনার পেটে। দুলালের নদীকেন্দ্রীক ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। পেশায় তিনি মৎস্য ব্যবসায়ী। বর্তমানে নদী থেকে ধরা বাগদা চিংড়ির পোনা ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া নদীতে জেগে ওঠা চরে থাকা মহিষের দুধ দিয়ে তৈরি দধি বিক্রিও তার ব্যবসার আরেকটি অংশ।  

নদী তাকে জীবিকার সুযোগ করে দিলেও কেড়ে নিয়েছে বাসস্থান। দুলালদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চরজগবন্ধু গ্রামে। দুলাল তার স্ত্রী-সন্তানসহ যে বসতঘরটিতে থাকতেন, সে ঘরের ভিটার একটি অংশ নদীতে ভেঙে গেছে। তবে কয়েক মাস আগে তিনি ঘরটি সরিয়ে নিয়ে উপজেলার করইতোলা এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন।

নদীর তীরে থাকা পরিত্যক্ত ভিটার সামনে লাগানো আছে বেগুন, মরিচসহ বিভিন্ন সবজির গাছ। আশপাশে কয়েকটি নারিকেল গাছ, তাতে ঝুলে আছে নারিকেল।  

দুলাল বলেন, বসতঘরটি নেই, কিন্তু কিছু স্মৃতি এখনো রয়ে গেছে। তবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের বসতঘরের ভিটা, বেগুন ক্ষেত কিংবা নারিকেল গাছের কোনো চিহ্ন থাকবে না।  

মেঘনা নদী শুধু দুলালদের বসতি কেড়ে নেয়নি, নিয়েছে ফসলি জমি, ফলদ বাগান, মাছের পুকুর। সেই সঙ্গে সাজানো-গোছানো একটি বসতি।   

দুলালের পাশের বাড়িটি ইসমাইল খলিফার। ওই বাড়ির পূর্ব পুরুষ ছিলেন সফিক উল্যা। তার পাঁচ ছেলে। তিনি প্রায় ৬০ বছর আগে এখানে বসতি স্থাপন করেন। সফিক উল্যা বেঁচে নেই। তবে পাঁচ ছেলের পাঁচটি বসতঘর ছিল ৪২ শতাংশের এ বাড়িতে। এছাড়া রান্নাঘর, গোয়ালঘর, পুকুর এবং বাগান ছিল এ বাড়িতে। পাশেই ছিল ফসলি জমি। বাড়িতে সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ জন।  

কয়েক মাসের ব্যবধানে বাড়িটি এখন জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। সফিক উল্যার ছোট ছেলে আবুল হোসেন পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন বাড়িতে। পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে থাকেন একটি জরাজীর্ণ ঘরে। পেশায় তিনি কৃষক এবং মৌসুমি জেলে।  

রোববার (১২ জুন) বিকেলে কথা হয় আবুল হোসেনের সঙ্গে।  

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা পাঁচ ভাই মিলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে এ বাড়িতে থাকতাম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একজন মারা গেছেন। আমাদের বাড়ির সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০ জনের মতো। কিন্তু এখন বাড়িতে আমি এবং আমার স্ত্রী-সন্তান ছাড়া আর কেউ থাকে না। বাড়ির পেছনেই নদী। ভাঙতে ভাঙতে একেবারে বসতঘরের কাছে চলে এসেছে। সবাই বসতভিটা রেখে ঘর নিয়ে চলে গেছে। তারা এখন অন্যত্র বসবাস করছে। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাই এখনো এ বাড়িতেই আছি। আগামী এক মাস থাকতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে। প্রতিদিন ব্যাপকহারে বসতবাড়ি নদীতে ভেঙে যাচ্ছে। জমি কেনার সামর্থ্য নেই, তাই এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় যাব? 

আবুল হোসেন বলেন, আমাদের দুই একর ফসলি জমি ছিল। সেগুলো চাষবাস করে সংসার চালাতাম। কিন্তু জমিগুলো এখন নদীগর্ভে৷ তাই চাষের জমি নেই। বাগদার মৌসুমে নদী থেকে চিংড়ি পোনা ধরে কোনোমতে সংসার চালাই।

তিনি বলেন, বাড়ির আশপাশে নারিকেল সুপারির বাগান আছে। এছাড়া আম, কাঁঠাল, জাম্বুরা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফলদ গাছ আছে। এগুলো এখন ভাঙনের কবলে পড়েছে। ভাবতেই কষ্ট হয়, নিজের হাতে সাজানো বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। ১০-১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছি। তখন ১০-১২ কিলোমিটার দূরে নদী ছিল। কিন্তু এ বাড়ি রাক্ষুসে মেঘনার পেটে চলে যাচ্ছে।  

আবুল হোসেনের ভাতিজা ইমাম হোসেন বলেন, এ বাড়িতে আমাদের ঘর ছিল। আমরা এখন অন্যত্র চলে গেছি। বসতভিটা, ফলদ গাছ এখনো আছে। তবে তা আর বেশিদিন টিকবে না।  

আবুল হোসেনের স্ত্রী তাসনুর বেগম বলেন, বাড়িতে পাঁচ পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতাম। এখন আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আমরা কোথায় যাব, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।  

আবুল হোসেনের ভাই নুর হোসেন বলেন, কয়েক মাস আগে আমি পরিবার নিয়ে বাড়ি ছেড়ে এক কিলোমিটার দূরে চলে যাই। নদী খুব কাছেই চলে এসেছে। জোয়ার আসলে ঘরে পানি ঢুকে যেত। কোমর সমান পানি হয়। তাই বসবাস করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল।  

দুলাল এবং আবুল হোসেনদের আক্ষেপ, গত জানুয়ারি মাসে মেঘনায় তীররক্ষা বাঁধের কাজের উদ্বোধন হয়। যে স্থান থেকে কাজ শুরু হওয়ার কথা- সেটি তার বসতবাড়ির ঠিক কাছেই। সঠিক সময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজটি শুরু হলে তাদের বসতবাড়ির কিছু অংশ হলেও রক্ষা পেত। কিন্তু কাজের কোনো অগ্রগ্রতি নেই। বাড়ির সামনেই তাদের পূর্ব পুরুষের কবরস্থান, সেটিও এখন আর রক্ষার উপায় দেখছেন না তারা।

লক্ষ্মীপুরের মেঘনার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙনে উপকূলীয় বাসিন্দাদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে।  

স্থানীয়রা জানান, গত ৩০ বছরে মেঘনা নদীর ধারাবাহিক ভাঙনে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার প্রায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ সময় ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক বাসিন্দা। গত বছরের জুন মাসে লক্ষ্মীপুরের রামগতির বড়খেরী ও কমলনগর উপজেলার লুধুয়াবাজার এবং কাদিরপন্ডিতেরহাট এলাকা পর্যন্ত ভাঙনরোধ কল্পে মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন হয়। ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। একই বছরের আগস্ট মাসে প্রকল্পের টেন্ডার হয়। দ্রুত বাস্তবায়নে পুরো কাজ ৯৯ প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।  

উদ্বোধনের পর সামান্য কিছু জিও ব্যাগ ডাম্পিং করার পর বালু সংকট দেখিয়ে কাজ বন্ধ রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। কাজের অগ্রগতি না থাকায় উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আর বাস্তহারা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।   

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।