ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উড়ির চরের জীবন যেমন (১ম পর্ব)

তবুও জীবন থেমে নেই!

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০২২
তবুও জীবন থেমে নেই! উড়ির চরের একাংশ। ছবি: বাংলানিউজ

উড়ির চর (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: সাগর-নদীর অবারিত জলরাশি বেষ্টিত ছোট্ট জনপদ ‘উড়ির চর’। জোয়ার-ভাটায় তাল মিলিয়ে চলে এখানকার জীবন।

১৯৮৫ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলার মতো বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই টিকে আছে এ চরের লড়াকু মানুষ।  

অতীতে দস্যুতার রাজত্ব থাকলেও এখন ফিরেছে শান্তি, অন্ধকার চরে জ্বলছে বিদ্যুতের বাতি। সুদিন ফিরলেও সংকট এখনও অনেক। চারদিকেই পানি হওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, দুই জেলার মধ্যে সীমানা বিরোধ ও নদী ভাঙনের মতো সমস্যা টেনে ধরেছে চরের অগ্রগতি।  

ধান, সবজি, মাছ ও কাঁকড়ায় সমৃদ্ধ এই চরের বর্তমান চিত্র দেখে এসে লিখেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম। ৬ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ।  

আমার গহীন জলের নদী, আমি তোমার জলে রইলাম ভেসে জনম অবধি। তোমার বানে ভেসে গেল আমার বাঁধা ঘর, চরে এসে বসলাম রে ভাই, ভাসালে সে চর, এখন সব হারিয়ে তোমার জলে-রে আমি ভাসি নিরবধি। - গীতি কাব্যে কবি নজরুল ইসলাম যেন উড়ির চরের মানুষদের কথাই বলছিলেন।

নদী ভাঙনের ফলে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মূল ভূখণ্ড থেকে ঘর-বসতি হারা মানুষগুলো বসতি গড়েছেন সবুজ ঘাসের এ চরে। এখন চরটিও ভাঙছে। নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জের সাথে সীমানা বিরোধের জেরে দুই দশকের বেশি সময় নেই নির্বাচন। নেই কোন নির্বাচিত জন প্রতিনিধি। তবুও যেন থেমে নেই জীবন, চলছে তার নিজস্ব নিয়মে। প্রায় ৪০ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপ জনপদের ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিত্যদিন সংগ্রাম করেই টিকে আছে।  

চরে যাওয়ার পথে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্চের মুছাপুর গুচ্ছগ্রাম ঘাটে কথা হয় ঘাটের কেরাণী মো. সারোয়ার আলমের সাথে। উড়ির চরের নানা উত্থান-পতন এই মানুষটির দেখা।  

তিনি জানান, ‘প্রতিদিন প্রায় শ’পাঁচেক মানুষ এই ঘাট দিয়ে চলাচল করে, যোগাযোগের জন্য নদী পথই চরের বাসিন্দাদের এক মাত্র উপায়। কেউ অসুস্থ হলে কিংবা কোন বিপদ হলেও এই নৌকার জন্যও অপেক্ষা করে থাকে মানুষ। মোটরসাইকের, বাইসাইকেল, হাঁস, মোরগ, গরু, ছাগল, মহিষ থেকে শুরু করে সব পার হয় নৌকা দিয়েই। তেলে চালিত এ নৌকায় নদী পারাপারে জনপ্রতি ভাড়া নেওয়া হয় ৭০ টাকা। মোটরসাইকেল ও গরু, মহিষের জন্য দ্বিগুণ গুনতে হয়।  

উচির চরে যাওয়ার জন্য আরও একাদিক ঘাট থাকলেও আমাদের জন্য সুবিধাজনক হওয়ায় আমরা এখান দিয়ে যাই। চলের দক্ষিণপ্রান্তে প্রধান ঘাট। সন্দ্বীপের কালাপানিয়া, সীতাকুণ্ডের কুমিরা ও লক্ষ্মীপুরের চরলক্ষ্মী থেকে আসা যাত্রীবাহী ট্রলারগুলো এখানেই ভিড়ে। পশ্চিমে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে যোগাযোগের জন্য রয়েছে আরেকটি ঘাট। সেখান থেকে চর এলাহীর ক্লোজারঘাটে পার হওয়া যায়। যাতায়াত করতে হয় জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মিল রেখে।  

নদীর এপাড় থেকে ওপাড়ের চর দেখাই যাচ্ছিলো। নৌকায় উঠে ভাবলাম হয়তো মিনিট ১৫ লাগবে কিন্তু না ওপাড় অব্দি পৌঁছাতে লেগেছে পৌনে ১ ঘণ্টা। গরু, ছাগলের সাথে গাদাগাদি করে পার হতে হয়েছে। নৌকা থেকে নেমে তীরে উঠতে গিয়ে দেখা গেল বড় বিপত্তি। এখানে কোন জেটি ঘাট নেই। হাঁটু পরিমাণ কাদা পেরিয়ে উঠতে হবে চরে। সবার যে দশা আমাদেরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কুলে উঠতে গিয়ে পরনের প্যান্ট তুলতে হয়েছে হাঁটুর ওপর তবুও রক্ষা হয়নি, কাদায় একাকার হতে হয়েছে।  

কাদা-পানি মাড়িয়ে ওপরে উঠে যা দেখলাম তাতে যে কেউই মুগ্ধ হবেন। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। মনে হচ্ছিল কেউ যেন সবুজ রঙা চাদর পেতে রেখেছে। বিস্তৃর্ণ মাঠ জুড়ে শুধুই সবুজ ঘাস। এ ঘাসকে স্থানীয়রা উরি বলে ডাকেন। জনশ্রুতি আছে এখান থেকেই নাকি এ চরের নাম উড়ির চর।  

ভ্রমণ যাত্রায় আমার সাথে থাকা সজীব রায়হান ও রুবেল জানালেন, আমাদের কমপক্ষে মাইল দুই হাটতে হবে। তারপর আমরা চরের ভেতরে যাওয়ার পরিবহন পাব।  

এদিকে সূর্যটা একদম মাথার ওপর। প্রখর রোদে ঘাম ঝরলেও চার পাশের সবুজ দেখে ক্লান্তি ভর করতে পারেনি। আধ মাইল হাটার পর দেখা পেলাম ধানক্ষেত। ক্ষেতের মাঝে আঁকা-বাঁকা পথ ধরে হাঁটছি তো হাঁটছি, পথ যেন শেষই হচ্ছিল না। ভ্রমণ সঙ্গীরা ২ কিলোমিটার বললেও আমার কাছে এর দ্বিগুণ মনে হলো। হাঁটাপথে ধানের জমিতে দেখলাম পানিতে মাছের লম্ফ-ঝম্ফ। যেখানেই একটু পানি সেখানেই মাছ।  

সফরসঙ্গী উড়ির চরের স্থানীয় বাসিন্দা রুবেল বলেন, এখানে মাছের অভাব নেই। প্রচুর মাছ পাওয়া যায় খালে, জলাশয়ে।  

আরও কিছু দূর হাঁটার পর দেখা মিললো একটি খাল পাড়ে বেশ কিছু নৌকা রাখা। দূরেই ধানক্ষতে পাশে একটি চৌ-চালা টিনের ঘর।  

অপর ভ্রমণসঙ্গী সজীব রায়হান জানালেন, আমরা এসে পড়েছি ওখানটায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে মোটরসাইকেল। সজীব জানালেন এই চরের অভ্যন্তরে মোটরসাইকেলই প্রধান ভরসা। এটা দিয়েই মানুষ দূরে পথে চলাচল করে। এখানে মোটরসাইকেল ভাড়ায় মিলে।  

আসার পথে এই যে নদী পার হওয়া, কাদা-মাটি মাড়িয়ে তীরে উঠা, ঘাসের চর ও ধানের জমি পেরিয়ে রাস্তায় আসা- এমন দূর্গম পথ অতিক্রম করেই এখানকার মানুষ নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। কষ্টের এই পথকে তারা সহজ করে নিয়েছেন।  

আমাদের গন্তব্যে যাওয়ার মোটরসাইকেলে ওঠার আগে কথা হয় সেলিম খোনার নামে চরের এক প্রবীণ বাসিন্দার সাথে। এক নৌকাতেই আমরা নদী পার হয়েছি।  

তিনি জানান, এক/দুই বছর নয় প্রায় ৪০ বছর ধরে এভাবেই যাতায়াত করছেন তিনি। ডাক্তার-কবিরাজ থেকে শুরু করে সবকিছুর জন্য যেতে হয় নোয়াখালী কিংবা সন্দ্বীপ। নদীতে এ ট্রলার ছাড়া আর কোন বাহন নেই।  

মোটরসাইকেলে উঠে আমরা এগোচ্ছিলাম। দুই পাশেই ধানক্ষেতের মাঝে মাঝে একটি দুটি বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। মাটি পেরিয়ে ইটের রাস্তায় কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়লো একটি বাজার। আমরা সেখানেই থামলাম। অনেক খোঁজাখুজির পর একটি দোকানে কিছু সিঙ্গারা পাওয়া গেল। ঢুকে পড়লাম সেখানেই। স্থানীয় একজন জানালেন এটি সমিতি বাজার। সিঙ্গারা খেতে খেতে চোখ যায় সামনের একটি স্বর্ণকার দোকানে। সেখানে স্বর্ণ না থাকলেও কারিগর আছেন একজন।  

দোকানের নাম ফলকে লেখা সমিতি বাজার-চর এলাহী, কোম্পানীগঞ্জ। মনে খটকা লাগলো, আছি সন্দ্বীপের উড়ির চরে, লেখা কোম্পানীগঞ্জ!

সাথে থাকা সজীব ও রুবেল জানান, সমস্যা এখানেই এই চরে রয়েছে দুটি জেলার দুই উপজেলার ভূমি। এই বাজারটি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নের। যদিও ওয়ার্ডটির বিভিন্ন অংশে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের উড়ির চরের সীমানা নিয়ে বিরোধ চলছে। দোকানটিতে বসে চা আড্ডায় উঠে আসছিলো নানা কথা। নিজেদের নানা সমস্যার কথা জানাচ্ছিলেন স্থানীয়রা। (চলবে) ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টাম অক্টোবর ২০, ২০২২
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।