ঢাকা, বুধবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

আদালত

‘মিসকোট করবেন না, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৭
‘মিসকোট করবেন না, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়’ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা; ছবি- দীপু মালাকার

ঢাকা: আদালতে মামলার শুনানিকালে বিচারক ও আইনজীবীর মধ্যে কথাবার্তার সময় বিচারপতিদের বক্তব্যের ‘মিসকোট’ না করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আইন বিষয়ক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান তিনি।     

প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনাদের কাছে আমার একটা আবেদন।

আমাকে মিসকোট করবেন না। আমাকে নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আমি আদালতে যা বলি, তার কিছু ‘ডিস্টর্টেড’ হয়। এতে আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এটি যেন আমাকে না পড়তে হয়’।

তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলন করে কোনো কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিচারক হিসেবে কোনো মামলার শুনানির সময় আইনজীবীকে একটি প্রশ্ন করতেই পারি, এটি আমার স্বাধীনতা। প্রশ্নটি কি কারণে কোন উদ্দেশ্যে, তা না বুঝে কোট করলে, অনেক সময় ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। এটি একটু খেয়াল করবেন’।

অ্যাডভোকেট শান্তিপদ ঘোষ রচিত ‘জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী।
 
প্রধান বক্তা ছিলেন ড. কামাল হোসেন। বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, আইনজীবী আসাদ হোসেন চৌধুরী, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাতুল্লা শহীদুল ইসলাম শাহীন, মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান প্রমুখ।
 বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা; ছবি- দীপু মালাকার
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমেরিকার প্রধান বিচারপতি আর্ন ওয়ারেন্ট জেলা আদালতে ওকালতি আরম্ভ করেছিলেন। এরপর তিনি সরকারি উকিল হয়েছিলেন। তার মেধার কারণে তিনি তিন তিনবার গভর্নর হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রিপাবলিকন দলের। কিন্তু ১৯৭০ সালে যখন গভর্নর হন, তখন তার নিরপেক্ষতার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সবাই তাকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- তিনি আর রাজনীতি করবেন না’।
 
‘আমরা বিচারকদের হয়তো ছাত্রজীবনে বা পেশাগত জীবনে প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনা থাকতে পারে রাজনীতি নিয়ে। আমরা বিচারকরা যখন বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করি এবং দেশে যারা বিচারক আছেন- আপিল বিভাগে, হাইকোর্ট বিভাগ কিংবা নিম্ন আদালতে, তাদেরকে বলবো- আপনারা আপনাদের অতীত ভুলে যান। এ বিচার বিভাগের আপনি যখন বিচারক আপনাকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে’।
 
‘সারা বাংলাদেশে মাত্র ১৫/১৬শ’ বিচারক। অনেক.. আমরা দেখি, নিরপেক্ষভাবে বিচার করার জন্য। বিচার করতে গেলে কে কি রাজনীতি করতেন সেটি, যদি রাজনীতি করতে হয়, আপনারা ছেড়ে চলে আসেন। বিচারক যদি হন, নিরপেক্ষভাবে করবেন। এটি আপনাদের প্রতি মানুষের অধিকার’।
 
আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘এ সমাজে আপনাদেরও অনেক কিছু করার আছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আপনারা এক হন। আমি আগেও বলেছি, আজকেও বলছি, আপনাদের প্রফেশনাল জীবন একটু কম দেখা যাচ্ছে’।
 
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে ১৫ আগস্ট কয়েকজন বিপথগামী লোক নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন। আমি এ মামলার চূড়ান্ত রায় ও রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি নিজের হাতে করেছি’।
 
‘একটি বাচ্চা ছেলে রাসেল, তাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? এটি পশুর চেয়েও .... কিন্তু এর নথি যখন পর্যালোচনা করলাম, যেহেতু এটি চূড়ান্ত আদালত, আমরা দেখলাম, অনেক ত্রুটি ছিল- এ মামলায়। যে রকম তদন্তের ত্রুটি ছিল, সে রকম প্রসিকিউশনের ত্রুটি ছিল। আমি হয়তো ভবিষ্যতে কিছু লেখার চিন্তা-ভাবনা করছি’।

‘আমি তুলে ধরবো- শুধু এ মামলা নয়, জেল হত্যা মামলাও। সেখানেও কিন্তু অনেক ত্রুটি ছিল এবং অনেক গাফিলতি ছিল। আপনারা দু’টি রায় পর্যালোচনা করে দেখবেন। আমরা বিচারিক আদালতের রায় এবং আপিল হাইকোর্টের রায় কিন্তু আমরা মানিনি। আমরা দুই রায়ই না মেনে পরিস্কার বলেছি- এটি ক্রিমিনাল কন্সপেরেসি ছিল’।
 
‘ক্রিমিনাল কন্সপেরেসি যদি হয়, এটি একেবারে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কন্সপেরেসি হয়েছে। এ কন্সপেরেসিতে কে কে জড়িত ছিলেন? কন্সপেরেসিতে যদি একজন লোকও থাকেন এবং তার সঙ্গে যদি আর যারা আছেন- প্রত্যেকেই সমভাবে দায়ী’।
 
তিনি বলেন, ‘আমরা মাত্র ১৫, ১৬, ২০ জনের বিচার করেছি। যারা সেই রাতে মার্চ করেছিলেন, মার্চ করার পরে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, মার্চ করে ৩২ নম্বরে আনা হয়েছে, তখনতো কন্সপেরেসি ক্লিয়ারলি ডিসক্লোজড হয়ে গিয়েছিল। এখন যারা বড় বড় কথা বলেন, আমি একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে মুখ খুলতে পারছি না’।

‘কিন্তু আমি হয়তো কিছু লিখে যাবো। আমি দেখিয়ে দেবো- যারা ষড়যন্ত্রের মধ্যে, কারা কারা ছিলেন। কি ধরনের গাফিলতি হওয়ার পরেও যারা সেনাবাহিনীর মধ্যেও অনেকজন- যারা কোষাগার থেকে সুবিধা নিয়ে চলে গেছেন। তারা তো পাওয়ার কথা ছিল না’।

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে ঐক্যবদ্ধভাবে দাড়াতে হবে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি- কোন শক্তি আছে? আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হই। আমাদের সংবিধানের নীতি-আদর্শ মানতেই হবে, মানতে হবে। কোন শক্তি আছে- সংবিধানকে অমান্য করবে? বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সংবিধান জাদুঘরে আছে। এটিকে কেউ অসম্মান করতে পারেন? আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম। আজীবন দেশ শাসন করতে পারেন। কেউ পারবেন না, আমি দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধু যেটি দিয়ে গেছেন- সেটিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই, ১৬ কোটি মানুষের। এ রাষ্ট্রে একজনও নেই, যিনি বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সংবিধানকে অসম্মান করবেন। কোন বাপের বেটা আছে, আসো আমার সামনে’।

‘সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রের যে চরিত্র এটিকে রাজতন্ত্র বানানোর কারো অধিকার নেই। এখানে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র থাকবে’।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৭
ইএস/আরআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।