‘পলিটিক্যাল হাব’- কথাটার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ যতোটা পরিচিত তার চেয়ে বেশি পরিচিত ‘পলিটিক্স’-এর সঙ্গে। এবং বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সেটা অনেক বেশি নেতিবাচক অর্থে।
‘কবে হবে’- এ প্রশ্নের উত্তর শুধু আমাদের রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোরই জানা আছে। ভুল। ভুল বলা হলো। আসলে তারাও জানেন না। জানালে দেশের সাম্প্রতিক চেহারাটা কি ওরকম হতো! মানুষ কি হরতাল-অবরোধের নামে ‘পেট্রোল বোমা’-আতঙ্কে ভুগতো! আর দেশ কি রাজনৈতিক সহিংসার আগুনে পুড়তো! দেশ পুড়ছে। তাই অস্ট্রেলিয়ায় থাকা প্রবাসী বাঙালিদের মনটাও পুড়ছে দেশের জন্য। কখনো কখনো সেটা ক্ষোভের আগুনে। কখনো আবার দু:খের আগুনে। ক্রিকেটের সৌজন্যে যারা বাংলাদেশি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে একটু গর্বটর্ব করছেন, তারা হতাশ নিজের দেশের রাজনীতির চেহারাটা দেখে। সিডনি থেকে ক্যানবেরা আসার পথে মনে হচ্ছিলো এখানে বোধহয় ‘বাংলাদেশ ডে’ - বলে কোনো উৎসব হচ্ছে। রাস্তায় শতকরা ষাট থেকে সত্তর শতাংশ গাড়িতে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা! আর সেই গাড়ির মিছিল ক্যানবেরার মানুকা ওভালমুখি। যেখানে ক্রিকেটের ‘মহাযজ্ঞ’ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ মুখোমুখি আফগানিস্তানের। ‘আফগানিস্তান’ শব্দটা শুনতেই মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ভূখন্ড। যেখানে মানুষের কানে বাজে গোলার শব্দ। বাতাসে ভাসে বারুদ্ধের গন্ধ। বোমা-রকেট-ড্রোন হামালায় যে দেশটার হৃদয় রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, সেই দেশটাও যেন ক্রিকেটের হাত ধরে করে উঠে দাঁড়াতে চাইছে। নতুন করে পরিচিত হচ্ছে। নতুন স্বপ্ন বুনছে। আর এই ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ যারা সেই বাংলাদেশ এখন আতঙ্কগ্রস্ত। তার বৈশ্বিক পরিচিত না হয়ে ওঠে ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাস আর প্রেটোল বোমার দেশ’ হিসেবে! একটা গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতির নামে বর্তমানে যা হচ্ছে সেটা বিশ্ববাসীরও এখন উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কারণ। অস্ট্রেলিয়ানরা নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে যতোটা প্রচার-প্রচারণা করছে, তা দেখে অনেকে বলছেন: এরা কৃপণ! কৃপণ না হলে বিশ্বকাপ নিয়ে এতোটা নিশ্চুপ থাকবে কেন তারা? প্রচার-প্রচারনায় অবশ্য একটা খরচাপাতি লাগে। তা তারা করছেন বলে মনে হচ্ছে না। বরং বিশ্বকাপের এই ম্যাচ নিয়েই ক্যানবেরায় বাঙালিরা যে প্রচারনাটা করে গেলেন, তাতে অভিবাসী হিসেবে তাদের বিশেষ মর্যাদা দেয়ার কথা ভাবতেই পারে অস্ট্রেলিয় সরকার। কিন্তু তারা তা ভাববে না সেটা জোর দিয়েই বলা যায়। কারণ, অস্ট্রেলিয়ানদের দেখে মনে হচ্ছে প্রচারবিমুখ।
অস্ট্রেলিয়ার খোদ রাজধানীতে রাজনীতি নামক কোনো প্রচার-প্রচারণা দূরে থাক। ক্রিকেট নিয়েও তেমন প্রচারণা নেই! যেটুকু যা তাই ঐ বাঙালিদের সৌজন্যে! কিন্তু এর মাঝে আবার একটা অন্যরকম প্রচারণাও চোখে পড়লো। অস্ট্রেলিয়ার এই রাজধানী হচ্ছে তাদের ‘পলিটিক্যাল হাব!’ সে কথাটা বিশ্বকাপ নিয়ে প্রকাশিত গাইড বুকেও স্পষ্ট করে লেখা। এখান থেকেই মূলত অস্ট্রেলিয়া সরকার পরিচালিত হয়। রাজনীতি পরিচালিত হয়। আবার যে রাজনীতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মানুষের আগ্রহ ক্রিকেট কিংবা অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে অনেক কম। অস্ট্রেলিয়ার এই পলিটিক্যাল হাব-এ আছে তাদের দেশের একামাত্র ‘ডেমোক্রেসি মিউজিয়াম’-টাও। গণতন্ত্রের জাদুঘরটাকে অস্ট্রেলিয়ানরা সযতেœ রেখেছে পুরনো পার্লামেন্ট হাউজে। বর্তমান পার্লামেন্টের সঙ্গে একই সরণিতে।
অস্ট্রেলিয়ার গণতন্ত্র খুব যে বেশি পুরাতন তা নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক চেতনা তাদের সেই ব্রিটিশ শাসনের লেজ ধরে। যে দেশটার প্রায় অর্ধেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে অভিবাসী তাদের জন্য গণতন্ত্রের চেতনাটা খুব জরুরি। এমনটাই মনে করে আবার এখানকার ‘সান অফ অস্ট্রেলিয়া’ বলে দাবি করাদের অধিকাংশ। সে কারণেই কি তাহলে গণতন্ত্রের এই যাদুঘর? লিবারেল পার্টি কিংবা লেবার পার্টি এই দুটোর কোনো দলকেই খুব একটা পছন্দ করেন না তেমন একজন হেনরি কিং-এর সাফ জবাব: ‘রাজনীতিবিদরা যাতে রাজনীতির চরিত্রটা ভুলে না যান সে জন্যই গণতন্ত্রের এই জাদুঘর। ’ শব্দ প্রকৌশলী হিসেবে যিনি কাজ করেন, সেই হেনরি কিং যদি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার শব্দচিত্রটা পুরোপুরি জানতেন তাহলে হয়তো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে বলতেন,‘আপনাদের দেশে ডেমোক্রেসি মিউজিয়াম নেই তো কি হয়েছে! আপনাদের গণতন্ত্র যে কোনো সময় জাদুঘরে চলে যেতে পারে। ’ ভাগ্যিস; কথাটা তার মুখ থেকে শুনতে হয়নি!
বাংলাদেশ সময় ০৯৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে