হ্যামিল্টন থেকে: আপত মিল বলতে তাদের মধ্যে নামের আদ্যাক্ষর। দু’জনেরই নামের প্রথম অক্ষর ‘এম’।
তারপরও মাহমুদুল্লাহ যখন হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে অসাধারণ এক ইনিংস খেললেন, তা দেখে অকল্যান্ডের বাসিন্দাকে টেনে আনলেন তার এক সাবেক ক্যাপ্টেন। জেরমি কোনি, গোটা দু’য়েক বিশ্বকাপ খেলেছেন যিনি। ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যার নেতৃত্বে রুখে দিয়েছিল নিউজল্যান্ড ১৯৮৭-তে। সেই ভদ্রলোকই বার বার টেনে আনলেন ক্রো-কে!
মার্টিন ক্রো আসলেন। সেটা মাহমুদুল্লাহর ‘টাইমিংয়ের’ কারণে। ‘ওর টাইমিংটা ভাল। ও যেভাবে ইনিংসটা খেললো তা মার্টিন ক্রো-র কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাকে। অধিনায়ক হিসেবে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি। হ্যাডলি আর ক্রো-র মতো দু’জন ক্রিকেটার পেয়েছিলাম আমার দলে। ’
কিন্তু মার্টিন ক্রো-র সঙ্গে মাহমুদুল্লাহ! কেন নয়? পাল্টা প্রশ্ন কোনির। আমি তুলনা করছি না। মার্টিন গ্রেট। ক্লাসটাও আলাদা। কিন্তু এই ছেলেটা আজ যেভাবে ইনিংসটা খেললো তা আমাকে মার্টিন ক্রো-র কথা মনে করিয়ে দিলো।
হ্যাঁ, এরকম পরিস্থিতিতে আমি মার্টিনকে অনেক ইনিংস খেলতে দেখেছি। পরিস্থিতি নয়; ওর ইনিংসের বিন্যাসটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশ কিন্তু ২৭ রানে দুই ওপেনারকে হারিয়েছিল। রান রেটও ছিল স্লো। সেখানে এসে ইনিংস মেরামত করলো। তারপর রান রেটটা বাড়িয়ে নিলো। কাজটা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু সেটা করলো খুব সাবলীলভাবে! বলছিলেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক এই ব্যাটসম্যান অলরাউন্ডার।
বিশ্বকাপে পরপর দু’ইনিংসে সেঞ্চুরি। সেটা মার্টিন ক্রো-রও নেই। কিন্তু মাহমুদুল্লাহ করলেন। এরকম দুর্দান্ত সাফল্য বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ইতিহাসে অন্যকোনো ব্যাটসম্যানেরও নেই। অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদুল্লাহর সেঞ্চুরিটা টেলিভিশনে দেখেছিলেন কোনি। এরপর সেডন পার্কের সেঞ্চুরিটা দেখলেন নিউজিল্যান্ড রেডিওর কমেন্ট্রিবক্সে বসে। ডিনার ব্রেকে ইন্টারভিউ দিলেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকে। তার নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার। তার সময়ের ক্রিকেট। এসে গেলো অনেক প্রসঙ্গই।
কিন্তু মাহমুদুল্লাহর ঐ সেঞ্চুরিটা নিয়েই কথা হলো বেশি। তার কারণ, টেকনিক। এখনকার সময়ে টেকনিকে প্রায় থোড়াই কেয়ার করে ভুরি ভুরি রান করছেন ব্যাটসম্যানরা। সেখানে মাহমুদুল্লাহকে খানিকটা ব্যতিক্রম মনে করলেন জিওফ বয়কটের পর জেরমি কোনিও। ‘টেকনিক্যালি যথেষ্ট সাউন্ড মনে হলো ওকে। টাইমিংটা খুব ভাল করে। মনে হয় বলটা দেখার জন্য অনেক সময় পায়। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। দেখে শুনে শট খেলছে। আবার স্কোরবোর্ডও সচল রাখছে। যে কাজটা খুব সহজে করতেন মার্টিন। ’
বলতে বলতে যেভাবে মার্টিন ক্রোর প্রতি মুগ্ধতা ঝরে পড়লো তার গলায়, একইভাবে সেখানে এক ধরনের সহমর্মিতাও এসে গেলো। ‘খুব অসুস্থ মার্টিন। অতো বড় ক্রিকেটার। কতো জয় এনে দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডকে। কিন্তু সেই লোকটা এখন লড়াই করছেন ক্যান্সারের সঙ্গে! ভাবতে পারি না!’ খানিকটা ভারাক্রন্ত হয়ে পড়লেন মার্টিন ক্রোর এক সময়ের ক্যাপ্টেন।
মার্টিন ক্রোর প্রসঙ্গ থেকে আবার তাকে ফেরানো হলো মাহমুদুল্লাহর ইনিংস প্রসঙ্গে। ওই আপনাদের ব্যাটিং লাইনের ‘কি প্লেয়ার’। সঙ্গে মুশফিক। এই ম্যাচে রান পেলেন না মুশি। তবে আমার কাছে খুব ভাল মনে হয়েছে ওকে। এই ইনিংসে খুব খারাপ সময়ে আউট হয়েছে মুশফিক। ও থাকলে স্কোরটা তিনশ ছাড়িয়ে যেতো। মন্তব্য সাবেক নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের।
মাহমুদুল্লাহ ও মুশফিক দু’জনের খেলার ধরনটা দু’রকম। পর্যবেক্ষণ কোনির। মুশফিকের ব্যাটিংয়ের মধ্যে এক ধরনের তাড়াহুড়োর ব্যাপার আছে। যেটা মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিংয়ে নেই। ওকে অনেক বেশি কম্পোজড মনে হলো। মুশফিকের চেয়ে কাজটা কঠিন ছিল মাহমুদুল্লাহর। কিন্তু ও সেটা করলো দারুণভাবে। হ্যামিলটনের উইকেট নিউজিল্যান্ডের অন্য উইকেটের তুলনায় স্লো। সেখানে প্রথমেই দ্রুত দু’টো উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। আর পরিস্থিতি সামাল দিলেন মাহমুদুল্লাহ। ও কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে কোনো শট খেলেনি। যেটা ভাল ব্যাটসম্যানের লক্ষণ।
সেডন পার্কের এই উইকেটে স্লো বাউন্স। যাকে আমি বলি টেনিস বল বাউন্স। সেখানে ভাল ইনিংস খেলা কঠিন ছিল। বলতে বলতে কোনি আরো কিছু বাক্য যোগ করলেন মাহমুদুল্লাহ প্রসঙ্গে। যেখানে আবার চলে এলো সেই মার্টিন ক্রো-র প্রসঙ্গ। ভাল ব্যাটসম্যান থেকে আরো ভাল, আরো সুপিরিয়র ব্যাটসম্যান হতে হলে এরকম প্রেসার সিচুয়েশনে আরো কিছু ইনিংস খেলতে হবে। তাহলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। বোলারদের ওপর নিজের দাপটটা দেখাতে পারবে। কিন্তু তারপরও বলবো; বিশ্বকাপে পর পর দুটো সেঞ্চুরি! অসাধারণ!
জেরমি কোনির কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বলতেই হলো; মার্টিন ক্রো-রও কিন্তু বিশ্বকাপে পর পর দু’ম্যাচে সেঞ্চুরি নেই! তবে বিশ্বকাপ সেঞ্চুরি দিয়ে কি আর মার্টিন ক্রোকে মাপা ঠিক হবে! মার্টিন গ্রেট! গ্রেট ক্রিকেটার। আর মাহমুদুল্লাহকে ক্রো পর্যন্ত যেতে হলে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু সেই পথে যাত্রাটা তো শুরু করলেন তিনি। মার্টিন ক্রোর স্বদেশী কেউ যখন বলেন; ক্রোর মতো চাপের মধ্যেও ভাল ইনিংস খেলার ক্ষমতা দেখালো ছেলেটা! শুনতে খারাপ লাগেনি। তবে ওর ইনিংসটা দেখতে আরো ভাল লাগলো।
প্রথম দিকে ধৈয্যের পরীক্ষা দিলেন। তার পর চালালেন আগ্রাসন। ১২৩ বলে অপরাজিত ১২৮ রান। যেখানে ঠিক একডজন বাউন্ডারি আর তিনটা ওভার বাউন্ডারি। হাফ সেঞ্চুরি করতে অবশ্য ৬৪ বল খেলেছিলেন। কোনো ওভার বাউন্ডারি ছাড়া। বাউন্ডারি মেরেছিলেন সে সময় ছ’টা। কিন্তু ইনিংসের তিনটা বাউন্ডারির দু’টো মেরেছেন সেঞ্চুরি করার পথে। আর সেঞ্চুরি পেরিয়ে একটা। আর হ্যাঁ, আগ্রাসন!
ওটা কি জিনিস তা বোধহয় সবচেয়ে ভাল বুঝেছিলেন মিচেল ম্যাকক্লেনান। বাঁহাতি পেসার ম্যাকক্লেনানের ২৫টা ডেলিভারি খেলেছিলেন মাহমুদুল্লাহ। তা থেকে তুলে নেন ৩৮ রান। এক হালি বাউন্ডারির পাশাপাশি একটা ওভার বাউন্ডারি ছিল তার মধ্যে। টেলিভিশনের পর্দায় মাহমুদুল্লাহর ইনিংসের এই অংশটুকু দেখলে ‘হাইলাইটস’ ভেবে ভুল করতে পারেন মার্টিন ক্রোও! নিশ্চিত সেই ভুলটা মার্টিন করেন নি। কারণ, তার খেলা অনেক ইনিংসের মতোই একটা ইনিংস যে খেললেন মাহমুদুল্লাহ।
কিন্তু ভুল হতে পারে পাঠকের! এক সপ্তাহ পেরুতে না পেরুতেই আবার মাহমুদুল্লাহ বন্দনা! কিন্তু কি আর করা। ওর ব্যাট মনে হচ্ছে আরো বন্দনা আদায় করে নেবে ক্রিকেট লিখিয়েদের কাছ থেকে। স্যার ডনের শহরে সেঞ্চুরি করে আসতে না আসতেই মার্টিন ক্রোর দেশে এসে পরের ম্যাচেই সেঞ্চুরি! সেই ইনিংস নিয়ে শব্দ খরচ না করে উপায় কি!
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৫
** ক্লাস অব জিরো এইট! || অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অ্যাডিলেডে শরতের রংও যেন লাল-সবুজ | অঘোর মন্ডল, অ্যাডিলেড থেকে
** ওয়ানডে-তে বোলাররা এখন শ্রমিকের ভূমিকায়! অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** অনেক নাটক জন্ম দিতে পারে ইডেন পার্ক ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইয়র্কার এখন বিরল ডেলিভারি!॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** বিশ্বকাপের রান উৎসবে বাংলাদেশও ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** নেলসনে টাইগারদের তিন ‘ল্যান্ড’ হার্ডল ॥ অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ইংল্যান্ড পারলে বাংলাদেশ কেন নয়? । । অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** শচীন আছেন শচীন নেই! | অঘোর মন্ডল, অকল্যান্ড থেকে
** ব্রিলিয়ান্ট! সুপার! গ্রেট! অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সাকিব!|| অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** মিরপুর টেক্কা দিচ্ছে মেলবোর্নকে ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি নিয়ে বাকযুদ্ধ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** নীল-হলুদ নাকি লাল-সবুজের ঢেউ ॥ অঘোর মন্ডল, মেলবোর্ন থেকে
** চোক’ কি ক্রিকেটীয় জোক?। । অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** সাকিব-ই সেরা মানতে অসুবিধা কোথায়!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ব্রিসবেনে আক্ষেপের উল্টোপিঠে স্বস্তিও॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** বৃষ্টিবিলম্বিত ক্লার্কের ফেরা! না থেকেও আছেন আশরাফুল॥ ব্রিসবেন থেকে অঘোর মন্ডল
** শঙ্কার চোরা স্রোত ব্রিসবেনে॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে
** ম্যাচের নায়করা ছিলেন বাইশ গজের বাইরে। । অঘোর মন্ডল, ক্যানবেরা থেকে
** ‘সি’ ফর ক্রিকেট নাকি সাইক্লোন!॥ অঘোর মন্ডল, ব্রিসবেন থেকে