ঢাকা: শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট-প্রসঙ্গটি সামনে এলেই ভেসে ওঠে একটি ছবি। হুইল চেয়ারে বসে বলের উপর চোখ রেখে ব্যাট চালাচ্ছেন এক যুবক।
ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মহসিন ভেঙেছেন একের পর এক সীমাবদ্ধতা। শারীরিক প্রতিবন্ধী দল গড়ে ২০১৪ সালে ভারতে একটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরে মহসিনের নেতৃত্বাধীন দলটি। মহসিনের এ কৃতিত্ব সুনাম এনে দেয় বাংলাদেশকে। তখন বেশ হইচই হয় মহসিন ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করার সুযোগ পান মহসিন। মেলে প্রশংসা। তাতে মহসিনের স্বপ্ন আরও বড় হয়েছে।
মহসিনের স্বপ্ন কেবল নিজেকে নিয়ে নয়; দেশের শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটকে ঘিরে। বিশেষ করে, মহসিনের মতো হুইল চেয়ারে বসে যারা ক্রিকেট খেলেন তাদেরকে ঘিরে, ‘আমি স্বপ্ন দেখি আমার মতো যারা আছেন তারা দেশ-বিদেশে খেলে বেড়াবেন। আইপিএল, বিপিএলের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়েও হবে বিশ্ব আসর। সুযোগ থাকবে পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার। এ জন্য ক্রিকেট বোর্ড করে যাবে পূর্ণ সহায়তা। ’
বলে রাখা ভালো, মহসিন কেবল একজন ক্রিকেটার নন; সফল সংগঠকও। মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলি হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে পুরনাভা জাতীয় হুইল চেয়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টের সফল আয়োজনটি হয়ে গেল তারই উদ্যোগে। পুরনাভা’র পৃষ্ঠপোষকতা ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ইমাগো স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের সহযোগিতায় দেশের ৩২ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় টুর্নামেন্টটি। এর ‘মাস্টারমাইন্ড’ (মূল পরিকল্পনাকারী) মহসিনই।
এটি আয়োজনের জন্য দুই বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন মহসিন। টুর্নামেন্টের প্রস্তাবনা নিয়ে ঘুরেছেন খেলাধুলায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন এমনসব প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে। দুই বছরের চেষ্টার পর মহসিন পেয়েছেন সফলতা। এমন আনন্দের দিনে মহসিনের চোখে জল!
হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে যখন ফাইনাল ম্যাচ খেলতে নামছে খুলনা সাইক্লোন-চিটাগং রাইডার্স তখন এই প্রতিবেদকের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন মহসিন। দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা থেকে ৩২ জন শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একত্রিত করার আনন্দে কেঁদে দিয়েছেন ভাবলে ভুল হবে।
টুর্নামেন্টটি আয়োজন করতে যে কষ্ট করতে হয়েছে, সংগ্রাম করতে হয়েছে সেটি ভেবেই আসলে কাঁদছিলেন মহসিন, ‘দুই বছর ধরে স্বপ্ন দেখেছি এমন কিছু করার। অনেক কষ্ট করেছি। টঙ্গি থেকে ঢাকা আসা আবার বাসায় ফেরা। তিনবার বাস থেকে পড়ে গেছি। আসলে কষ্টটা করে যাচ্ছি ক্রিকেটকে ভালোবাসি বলেই। তারপরও আজ আমি অনেক খুশি। দোয়া করবেন যেন এ টুর্নামেন্টটা প্রতি বছর আয়োজন করতে পারি। ’
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) স্বীকৃত শারীরিক প্রতিবন্ধী যে দলটি আছে সেখানে নেই মহসিনের নাম। পাঁচ দেশের অংশগ্রহণে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) আয়োজন করে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। সেখানে খেলেছেন কম ত্রুটি সম্পন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধীরা। এ জন্য জায়গা হয়নি হুইল চেয়ারের ক্রিকেটে পারদর্শী মহসিনের।
মহসিনের আশা, শিগগিরই হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন এমন ক্রিকেটারদেরও স্বীকৃতি দেবে বিসিবি। সব কিছু দেখভাল করবে তারা। মহসিনরা কেবল খেলে যাবেন দেশ-বিদেশে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অনুরোধ জানাবেন হুইল চেয়ার ওয়েলফেয়ার অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মহসিন।
মহসিনের নেতৃত্বে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ভারতে এশিয়া কাপ খেলতে যাবে হুইল চেয়ার ওয়েলফেয়ার বাংলাদেশ দলটি। বাংলাদেশ ছাড়াও অংশ নেবে স্বাগতিক ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপের মতো দল। বোর্ডের স্বীকৃতি না থাকায় মহসিনের আবার পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে। টঙ্গি টু ঢাকা, ঢাকা টু টঙ্গি! ঝুঁকি নিয়েই বাসে চড়বেন মহসিন। এভাবে দৌড়ঝাঁপ করে অত বড় স্বপ্নের কতটুকুই আর বাস্তবায়ন করতে পারবেন ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জনক মহসিন?
২০১৪ সালে ভারতের টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার জন্য নিজের ফ্লেক্সিলোডের দোকানটাও বিক্রি করতে হয়েছে মহসিনকে। সেই থেকে বাবার অধীনেই চলছে মহসিনের সংসার। যে দেশে ১৫টির মতো বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল কিংবা হোম সিরিজের পৃষ্ঠপোষক হয়ে কোটি কোটি টাকা ঢালার আগ্রহ দেখায়, সে দেশে মহসিনের স্বপ্ন তো অসম্ভব কিছু নয়!
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৬
এসকে/এমআরএম
আরও পড়ুন...
* হুইল চেয়ারের ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন খুলনা সাইক্লোন