ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ক্রিকেট

ভয় পেয়েছিলেন কোহলিরা?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭
ভয় পেয়েছিলেন কোহলিরা? মাহমুদুল্লাহর দৃষ্টিনন্দন আরেকটি শট, পেছনে তাকিয়ে বিরাট কোহলি। ছবি: সংগৃহীত

পুজারা-কোহলি-রাহানে-অশ্বিনরা কি চতুর্থ ইনিংসে নামতে ‘আগাম ভয়’ পেয়ে গেলেন? বাংলাদেশ ফলোঅনে পড়ে যাওয়ার পরও বিরাট কোহলিদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামতে দেখে এ প্রশ্নটাই আলোচিত হতে থাকে দর্শক মহলে। টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ বা শেষ ইনিংসে উইকেটের আচরণ পরিবর্তনের কারণে ব্যাটিং আতঙ্কটা সব দলেরই থাকে, হুটহাট বল লাফিয়ে ওঠে, সুইং করে সমানে, খেলা হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। কিন্তু তাই বলে প্রথম ইনিংসে ২৯৯ রানে এগিয়ে থাকার পরও ‘শঙ্কায়’ ভুগতে হবে?

শঙ্কাটা যে ভারতকে পেয়ে বসেছিল তা কোহলিদের লিড হাতে রেখেও তৃতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ১২৮ রান তুলতে ৪ উইকেট খুইয়ে ফেলাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ম্যাচের চতুর্থ দিনের মাঝামাঝিতেই বল বুঝে উঠতে পারছিলেন না কোহলি-রাহানেরা।

চতুর্থ ইনিংসে অর্থাৎ পঞ্চম দিনে ব্যাট করতে হলে কী করতেন?

ম্যাচের ফল হয়ে গেছে। বিরাট কোহলিরা জিতে গেছেন ২০৮ রানে। পঞ্চম দিনে কী করতেন কপিল-আজহার-রবি শাস্ত্রী-সৌরভ-শচীনদের উত্তরসূরীরা তা নিয়ে হয়তো এখন তেমন আলোচনা হবে না।

কিন্তু সত্যিই যে ভারতীয় দলে ভয় ধরে গিয়েছিল, তা পঞ্চম দিনের প্রথম সেশন আর দ্বিতীয় সেশনের প্রথমাংশে হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের গ্যালারির নিশ্চুপ-নিস্তব্ধতাই প্রমাণ করেছে। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, সাব্বির রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ ও কামরুল ইসলাম রাব্বিদের ক্রিজে আটকে থাকার প্রচেষ্টায় ভারতীয় অধিনায়কের ফিল্ডারদের পজিশন বদল এবং আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজানোর আড়ালে নিজেদের ওপর চাপ কমানোর তৎপরতা আরও বেশি প্রকাশ করেছিল স্বাগতিক শিবিরের শঙ্কাকে।

বিশেষত রিয়াদ আর সাব্বির জুটির ব্যাটিংয়ের সময় কোহলির উদ্বেগভরা ছোটাছুটি স্পষ্ট করে তার কপালের চিন্তার ভাঁজ। যার প্রমাণ ইনিংসের ৭০তম ওভারে সাব্বিরের বিরুদ্ধে তার অযথা এলবিডব্লিউয়ের রিভিউ ডাক। চ‍াপের প্রমাণ দেখা যায় তারও আগে সৌম্যের বিরুদ্ধে কোহলির আরও একটি ব্যর্থ রিভিউ আবেদনে, ইশান্ত শর্মার বারবার স্লেজিংয়ে। আউট দাও! আউট দাও! চিৎকার ভারতীয় ফিল্ডারদের! ছবি: সংগৃহীতবাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ভারতের আমন্ত্রণে তাদের মাটিতে প্রথমবারের মতো খেলতে যাওয়া টাইগার বাহিনীর। ম্যাচে নামার আগে দুই দলের সামনে হিসাব ছিল এ রকম- ভারত টেস্ট খেলছে ১৯৩২ থেকে, বাংলাদেশ ২০০০ থেকে; বাংলাদেশ গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে অর্থাৎ প্রায় এক বছরে টেস্ট খেলেছে মাত্র ৪টি, আর ভারত ১২টি, কেবল নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই নিজেদের মাটিতে ৫টি টেস্ট খেলেছে; ভারত টেস্টে র‌্যাংকিংয়ে ১ নম্বর দল, বাংলাদেশ ৯ নম্বর। ছিল আরেকটা ছোট্ট হিসাব, র‌্যাংকিংয়ের ৪ নম্বর দল ইংল্যান্ড ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ৪-০ ব্যবধানে নাকানি-চুবানি খেয়ে গেছে, প্রথম ম্যাচটা কোনোমতে ড্র করে মান বাঁচিয়েছে।

এই হিসাব-নিকাশ সামনে রেখে টাইগারদের বোলিং আক্রমণের প্রাণভোমরা মোস্তাফিজুর রহমানকে ছেড়ে হায়দরাবাদের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার সময় অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ‘লড়াই’ করে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে যান।

ম্যাচ শেষে মুশফিকের সেই ঘোষণার কার্যকারিতা দেখতে মাঠের চিত্র বিশ্লেষণ করলে এ সিদ্ধান্তে আসতেই হবে যে, বাংলাদেশ কেবল লড়াই-ই করেনি, কার্যত টুটি চেপে ধরেছিল ভারতীয় বাহিনীর। ভয়-আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছিল রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের মাঠ এবং গ্যালারি এমনকি পুরো ভারতীয় ক্রিকেটপাড়ায়।

মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক, মাহমদুল্লাহ-সাব্বির এবং মিরাজ-রাব্বির জুটির সময় তো বারবারই মনে হচ্ছিল, এই জুটি বোধ হয় টিকে গেল। সেজন্যই কিনা ছোটাছুটি করছিলেন কোহলি। বারবার পরামর্শ করছিলেন অশ্বিন-জ‍াদেজা-ইশান্ত-ভুবনেশ্বরদের সাথে। বাংলাদেশ বুঝি প্রতিরোধ গড়ে ফেললো! কোহলি-অশ্বিনদের এই শঙ্কায় যেন কাঁপছিলো রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের গ্যালারিও। একটা ছোটখাট আবেদনে পুরো গ্যালারি ফেটে উঠে, ‘আরে, আউট দিয়ে দাও!’ একটা বাউন্ডারিতে পুরো গ্যালারি স্তব্ধ হয়ে যায়, ‘হায় কোহলি, করছো কী?’

ম্যাচের ফলাফলের সরল সমীকরণে হয়তো ফলাফলটা ভারতের পক্ষে গেল, কিন্তু প্রাপ্তির খাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে বাংলাদেশের দারুণ সব কৃতিত্ব। ২০০০ সালের পর ভারতের মাটিতে বেড়াতে যাওয়া দলগুলোর মধ্যে যারা চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশের বেশি সর্বোচ্চ ২৭২ রান করেছিল নিউজিল্যান্ড। সেটা ২০০৩ সালে। এরপর অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা পাকিস্তান, কেউ চতুর্থ ইনিংসে ২৫০ এর অংক ছুঁতে পারেনি। আর টেস্ট না খেলার ধারাবাহিকতা এবং অনেক বিবেচনায় নবীন ও তলানির দল হয়েও প্রথমবারের সাক্ষাতে ২৫০ করে ফেললো মুশফিকুর-মাহমুদুল্লাহ বাহিনী। কেবল তাই নয়, ভারতের মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ ওভার খেলার কীর্তির তালিকা ঘেঁটেও দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের এই ম্যাচের অবস্থান অষ্টম। হিসাবের খাতাটা কি বাংলাদেশের উত্থান জানান দেয় না?এই অর্জন আর কীর্তিগাঁথার মধ্যে এখন কিছু ‘হয়তো-যদি’র গল্প আসবে। যেমন, ‘যদি মুশফিকুর রহিম বা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ অমন হাওয়ায় ভাসানো শট না খেলতেন, তবে ম্যাচের ফলাফলটাও হয়তো অন্যরকম হতে পারতো’।

কিন্তু এ ‘হয়তো-যদি’ বাদ দিয়েও যে বাংলাদেশ খারাপ খেলেনি তার একটা ‘ইতিহাসভিত্তিক ব্যাখ্যা’ দেওয়া যেতে পারে। ভারত ১৯৩২ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর তাদের পর প্রথম জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত। শক্তিমত্তার দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে ভারতকে অপেক্ষা করতে হয়েছে সত্তরের দশকে সুনীল গাভাস্কার, গুন্ডাপা বিশ্বনাথ ও কপিল দেবদের মতো তারকাদের পাওয়া পর্যন্ত।

আর টেস্ট স্ট্যাটাস লাভের ২০ বছর পূরণ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ এরইমধ্যে পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। টেস্টে হারিয়েছে ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো বাঘা বাঘা দলকে। সিরিজের পর সিরিজে নাকানি-চুবানি দিয়েছে জিম্বাবুয়েকে।

‘ইতিহাসভিত্তিক ব্যাখ্যায়’ না গিয়ে শুধু ইউশা নামে ক্রিকইনফোর এক পাঠকের কথায়ই আসা যাক, “বাংলাদেশ এ ম্যাচে হারলেও তারা তাদের লড়াইয়ের দারুণ প্রমাণ দিয়েছে। আপনি যদি ম্যাচে প্রতিরোধ করাটা শিখে যান, তবে পরের ধাপটা হলো ম্যাচ জিতে যাওয়া শিখতে শুরু করা। ”

ম্যাচ শেষে টিম ইন্ডিয়ার উচ্ছ্বাসভরা উদযাপন আর ফটো সেশনের মহড়া কি ইউশার মন্তব্যেরই প্রতিধ্বনি নয়?

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।